জাতীয় সংবাদ

জর্ডানে ড্রোন হামলায় ৩ মার্কিন সেনা নিহত : আহত ২৫

ইরানে হামলা চালাতে বাইডেনের ওপর রাজনৈতিক চাপ বাড়ছে

প্রবাহ রিপোর্ট ঃ ইরাক ও সিরিয়ার মার্কিন ঘাঁটিতে থেমে থেমে ঘটছে হামলার ঘটনা। সবমিলিয়ে সিরিয়া ও ইরাক থেকে কিছু সেনাও প্রত্যাহার করতে শুরু করেছে জো বাইডেনের দেশ। তার মাঝেই ঘটল এক নতুন ঘটনা। এবার জর্ডানে মার্কিন সেনাদের ওপর হামলা হয়েছে।
ইসরাইলের প্রতিবেশী দেশটিতে ড্রোন হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের তিন সেনা নিহত হয়েছে। এছাড়াও আহত হয়েছে আরো ২৫ জন। ইউএস সেন্ট্রাল কমান্ড জানিয়েছে, সিরিয়া সীমান্তের কাছে জর্ডানের উত্তরপূর্বাঞ্চলের একটি ঘাঁটিতে ড্রোন হামলায় হতাহতের এই ঘটনা ঘটে। গত বছরের ৭ অক্টোবর হামাস-ইসরাইল যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এই প্রথম ওই অঞ্চলে মার্কিন সেনা নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটলো। নতুন হামলা নিয়ে বিবৃতিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, ‘আমরা এখনো এ হামলা-সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করছি। তারপরও আমরা জানি, সিরিয়া ও ইরাকে কার্যক্রম পরিচালনাকারী ইরান-সমর্থিত মৌলবাদী জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো এ হামলা চালিয়েছে।’ জো বাইডেন বলেন, ‘এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে এ হামলার পেছনে যারা রয়েছে, তাদের সবাইকে আমরা সময়মতো আমাদের পছন্দমতো কায়দায় জবাবদিহির আওতায় আনব।’
অপরদিকে ইরানে হামলা চালাতে বাইডেনের ওপর রাজনৈতিক চাপ বাড়ছে। জর্ডানে ড্রোন হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের তিন সেনা নিহত হয়েছেন। হামলায় আহত হয়েছেন আরও প্রায় ৩৪ জন। সিরিয়া সীমান্তবর্তী জর্ডানের একটি সামরিক ঘাঁটিতে হওয়া এই হামলায় ইরান জড়িত থাকতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। আর এরই জেরে ইরানে হামলা চালাতে বাইডেনের ওপর বাড়ছে রাজনৈতিক চাপ। যদিও ইরান বলছে, জর্ডানে ড্রোন হামলা এবং মার্কিন সেনাদের হত্যার সাথে তাদের কোনো যোগসূত্র নেই। সোমবার (২৯ জানুয়ারি) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে বার্তাসংস্থা রয়টার্স। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোববার ইরান-সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীর হামলায় তিন মার্কিন সৈন্য নিহত এবং আরও কয়েক ডজন আহত হওয়ার ঘটনাটি ইরানে সরাসরি হামলা করার জন্য প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ওপর রাজনৈতিক চাপ তৈরি করছে। যদিও বৃহত্তর যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কায় মার্কিন এই প্রেসিডেন্ট এতদিন এই ধরনের কোনও পদক্ষেপ নিতে অনিচ্ছুক ছিলেন। অবশ্য ড্রোন হামলায় ৩ মার্কিন সেনা নিহত হওয়ার পর প্রতিশোধের হুংকার দিয়েছেন বাইডেন। মার্কিন ডেমোক্র্যাটিক এই প্রেসিডেন্ট এক বিবৃতিতে বলেছেন, কোনও সন্দেহ নেই- আমরা একসময় এবং আমাদের পছন্দের পদ্ধতিতে দায়ী সকলকে জবাবদিহিতার আওতায় আনব। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাণঘাতী এই হামলার জবাবে বাইডেন ইরানের বাইরে এমনকি ইরানের অভ্যন্তরেও ইরানি বাহিনীকে লক্ষ্যবস্তু করে হামলা চালাতে পারেন। আবার সেই পথে না হেঁটে শুধুমাত্র ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়াদের বিরুদ্ধে আরও সতর্ক প্রতিশোধমূলক আক্রমণও বেছে নিতে পারেন। রয়টার্স বলছে, গত বছরের অক্টোবরে ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকান বাহিনীকে ইরাক, সিরিয়া, জর্ডান এবং ইয়েমেনের উপকূল থেকে ইরান-সমর্থিত বাহিনী ১৫০ বারেরও বেশিবার আক্রমণ করেছে। তবে সিরিয়ার সাথে জর্ডানের উত্তর-পূর্ব সীমান্তের কাছে টাওয়ার ২২ নামে পরিচিত একটি দূরবর্তী চৌকিতে রোববারের হামলার আগ পর্যন্ত আগের কোনো হামলাতেই মার্কিন সৈন্য নিহত বা এত বেশি সংখ্যক সেনা আহত হয়নি। রোববারের হামলার পর প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র এই হামলার প্রতিক্রিয়া জানাবে। তবে এ বিষয়ে আর বিশদ কোনো বিবরণ তিনি দেননি। বিরোধী রিপাবলিকানরা আমেরিকান বাহিনীকে ‘বসে থাকা হাঁস হতে দেওয়ার জন্য’ বাইডেনকে অভিযুক্ত করেছে। রিপাবলিকানদের দাবি, মার্কিন বাহিনী সেই দিনের জন্য অপেক্ষা করেছে যখন একটি ড্রোন বা ক্ষেপণাস্ত্র এসে সামরিক ঘাঁটির প্রতিরক্ষা ছিন্নভিন্ন করে দেবে। তারা বলছে, রোববার সেই দিনটি এসে গেছে। এদিনই রাতের আঁধারে জর্ডানে একটি সামরিক ঘাঁটিতে ড্রোন হামলা হয়। আর এর জবাবে তারা (রিপাবলিকানরা) বলছে, প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে এবার ইরানে অবশ্যই হামলা করতে হবে। রিপাবলিকান সিনেটর টম কটন বলেন, ‘তিনি (বাইডেন) আমাদের সৈন্যদের বসা হাঁসের মতো বসিয়ে রেখেছিলেন। এই হামলার একমাত্র উত্তর হতে হবে ইরান এবং মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ইরানের সন্ত্রাসী বাহিনীর বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক সামরিক প্রতিশোধ।’ রিপাবলিকান নেতা এবং মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক তদারকি কমিটির নেতৃত্বে থাকা প্রতিনিধি মাইক রজার্সও তেহরানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘সন্ত্রাসী ইরানি সরকার এবং তাদের চরমপন্থি প্রক্সিদের যারা এই হামলা চালিয়েছে তাদের জবাবদিহি আরও আগেই করা উচিত ছিল বাইডেনের।’
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও এই আক্রমণটিকে ‘জো বাইডেনের দুর্বলতা এবং আত্মসমর্পণের পরিণতি’ হিসাবে চিত্রিত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘জর্ডানে ইউএস মিলিটারি ইন্সটলেশনে ড্রোন হামলা এবং ৩ জন আমেরিকান সৈন্যের নিহত ও আরও অনেকের আহত হওয়ার এই ঘটনা আমেরিকার জন্য একটি ভয়ঙ্কর দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে… যুক্তরাষ্ট্রের ওপর এই নির্লজ্জ হামলা জো বাইডেনের দুর্বলতা এবং আত্মসমর্পণের আরেকটি ভয়ঙ্কর ও দুঃখজনক পরিণতি।’
বাইডেন প্রশাসন বলেছে, বিশ্বজুড় মার্কিন সৈন্যদের রক্ষা করার জন্য তারা অনেক বেশি পরিশ্রম করে। তবে গাজায় ইসরায়েল-হামাস সংঘাত নিয়ন্ত্রণে বাইডেনের কৌশল যে ব্যর্থ হচ্ছে সে বিষয়ে খোলাখুলিভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন একজন ডেমোক্র্যাট। ডেমোক্র্যাটিক প্রতিনিধি বারবারা লি বলেন, ‘যেমন আমরা এখন দেখছি, এটি (গাজা সংঘাত) নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এটি কার্যত আঞ্চলিক যুদ্ধ হিসাবে আবির্ভূত হতে শুরু করেছে এবং দুর্ভাগ্যবশত যুক্তরাষ্ট্র এবং আমাদের সৈন্যরা ক্ষতির পথে রয়েছে।’ এসময় ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের মধ্যকার এই সংঘাতে যুদ্ধবিরতির আহ্বানও জানান তিনি। এত সহজ নয় ঃ ডেমোক্র্যাটিক প্রতিনিধি শেঠ মল্টন ইরাকে মেরিন হিসেবে চারবার সফর করেছেন। রোববারের এই হামলার পর রিপাবলিকানদের যুদ্ধের আহ্বানের বিরোধিতা করে তিনি বলেছেন, ‘প্রতিরোধ করা কঠিন ; যুদ্ধ আরও খারাপ।’ তিনি বলেন, ‘ইরানের সাথে যুদ্ধের আহ্বান জানাচ্ছেন যারা, আপনারা শত্রুর হাতে খেলছেন এবং আমি দেখতে চাই, আপনারা আপনাদের ছেলে-মেয়েদের যুদ্ধে পাঠাবেন। পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে আমাদের সামনে অবশ্যই একটি কার্যকর, কৌশলগত প্রতিক্রিয়া থাকতে হবে।’ বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, ইরানের অভ্যন্তরে ইরানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যে কোনও হামলা তেহরানকে জোরপূর্বক প্রতিক্রিয়া জানাতে বাধ্য করতে পারে। সেই পরিস্থিতিতে উত্তেজনা এমনভাবে বেড়ে যেতে পারে যা যুক্তরাষ্ট্রকে মধ্যপ্রাচ্যের একটি বড় যুদ্ধে টেনে নিয়ে যেতে পারে। সেন্টার ফর এ নিউ আমেরিকান সিকিউরিটির মধ্যপ্রাচ্য নিরাপত্তা কর্মসূচির পরিচালক জোনাথন লর্ড বলেছেন, সরাসরি ইরানের অভ্যন্তরে হামলা তেহরানের জন্য শাসনব্যবস্থার টিকে থাকা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করবে। ওয়াশিংটন-ভিত্তিক মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের চার্লস লিস্টার বলেছেন, ইরাক বা সিরিয়ায় ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোর উল্লেখযোগ্য বিভিন্ন লক্ষ্য বা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য পাল্টা হামলা হতে পারে। তিনি বলেন, ‘আজ যা ঘটেছে, তা গত দুই থেকে তিন মাসে এই প্রক্সিরা যা করেছে তার চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল… (কিন্তু) ইরানে কিছু করার সমস্ত আহ্বান সত্ত্বেও আমি এই প্রশাসনকে তেমন পরামর্শ গ্রহণ করতে দেখছি না।’ সাম্প্রতিক মাসগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের বাইরে ইরান-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে। গত বছরের নভেম্বরে মার্কিন সামরিক বাহিনী বলেছিল, তারা কেবল ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠীই নয়, ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর ব্যবহৃত একটি স্থাপনাতেও হামলা করেছে। অবশ্য মার্কিন এক প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, ‘যদি যুক্তরাষ্ট্র সর্বাত্মক যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত না হয়, তাহলে ইরানে আক্রমণ থেকে আমরা কী পেতে পারি?’
জর্ডানে বর্তমানে তিন হাজার মার্কিন সেনা অবস্থান করছে। এর আগে ইরাক সিরিয়ায় রোষাণলে পড়লেও এবার ভূরাজনীতির নতুন খেলা দেখল যুক্তরাষ্ট্র। তাদের জন্য মধ্যপ্রাচ্যের আর কোনো জায়গাই নিরাপদ রইলো না।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button