জাতীয় সংবাদ

অমর একুশে আজ

এফএনএস: মহান ভাষা শহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস আজ। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি পূরণের ৭২ বছর পূর্ণ হচ্ছে এই দিনে। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ছিল ঔপনিবেশিক প্রভুত্ব ও শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালীর প্রথম প্রতিরোধ এবং জাতীয় চেতনার প্রথম উন্মেষ। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে দুর্বার আন্দোলনে সালাম, জব্বার, শফিক, বরকত ও রফিকের রক্তের বিনিময়ে বাঙালী জাতি পায় মাতৃভাষার মর্যাদা। রাষ্ট্রভাষার লড়াইয়ে সে দিন রাজপথ রঞ্জিত হয় ভাইয়ের রক্তে।
রক্তের ঋণে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ কবিতা লিখলেন। কবিতাটি মোট ৩০ লাইনের। কিন্তু এখান থেকে বেশ কয়েকটি লাইন অমর একুশের কালজয়ী গান হয়ে গেছে। এই গানটি আজ কোটি কোটি বাঙালী প্রাণের আবেগে দিনভর গাইবেন- ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি/ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু-গড়া এ ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি/আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি।’ এই গানটি প্রজন্মের পর প্রজন্মকে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি চেতনায় আজও অনুপ্রাণিত বাঙালী জাতি। এই কালজয়ী গানের বাণী দেশের মানুষের মনে প্রোথিত হয়েছে সেই থেকে। গানটি পাকি শত্রুদের বিপক্ষে ঘৃণা ক্রোধ আর দ্রোহের আগুন এখনও জ¦ালিয়ে তুলছে। পাকিস্তানের দোসর রাজাকার, আলবদর ও আলশামসদের বিচারের দাবিতে তরুণ প্রজন্ম রাস্তায় নেমে আসে। শাহবাগে গড়ে উঠে জাগরণ মঞ্চ। এই মঞ্চ এখন গিনেস বুকে স্থান করে নিয়েছে। বিশ্বের আর কোথাও এত দীর্ঘ সময় লাখ লাখ মানুষের জমায়েত হয়নি। একুশের সেই চেতনাই শিক্ষা দিয়েছে কোটি কোটি বাঙালীর মেধা ও মননে।
জাতিসংঘ সংস্থা ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালের ১৭ নবেম্বর ঐতিহাসিক মহান একুশের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার পর থেকে প্রতিবছর আন্তর্জাতিক পর্যায়েও দিবসটি পালিত হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও মহান শহীদ দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া পৃথক বাণী দিয়েছেন।
রাষ্ট্রপতি তাঁর বাণীতে বলেন, মহান ভাষা আন্দোলন আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এক ঐতিহাসিক ও অতীব তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এ আন্দোলন ছিল আমাদের মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন এবং পাশাপাশি এটি ছিল আমাদের জাতিসত্তা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষারও আন্দোলন। এ আন্দোলন অবিনাশী প্রেরণা হয়ে পরবর্তীকালে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠায় আমাদের শক্তি যুগিয়েছে। ১৯৭১ সালে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে আমরা অর্জন করেছি কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বাণীতে বলেন, মহান একুশে ফেব্রুয়ারি প্রতিটি বাঙালীর শোক, শক্তি ও গৌরবের প্রতীক। ১৯৫২ সালে ভাষার মর্যাদা রক্ষা করতে প্রাণ দিয়েছিলেন রফিক, শফিক, জব্বার, বরকত, শফিউদ্দিন, সালামসহ আরও অনেকে। আজকের এই দিনে আমি ভাষা শহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই। শ্রদ্ধা জানাই বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নেতৃত্বদানকারী সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং সকল ভাষাসৈনিকের প্রতি। ১৯৪৮ সালে ছাত্রলীগ, তমদ্দুন মজলিশ ও অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। ১১ মার্চ ১৯৪৮ সালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সংগ্রাম পরিষদ ধর্মঘট ডাকে। এ দিন সচিবালয়ের সামনে থেকে বঙ্গবন্ধুসহ অনেক ছাত্রনেতা গ্রেফতার হন। ১৫ মার্চ তাঁরা মুক্তি পান। ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় অনুষ্ঠিত জনসভায় সভাপতিত্ব করেন শেখ মুজিবুর রহমান। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে।
দিবসটির তাৎপর্য তুলে ধরে দেশের সরকারী-বেসরকারী টেলিভিশন, রেডিও এবং কমিউনিটি রেডিও ব্যাপক অনুষ্ঠানমালা প্রচার করবে। জাতীয় দৈনিকগুলোতে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ঢাকা শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক দ্বীপগুলো এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে বর্ণমালা সংবলিত ফেস্টুন দিয়ে সজ্জিত করা হবে।
রাজধানীতে বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, শিশু একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, নজরুল ইনস্টিটিউট, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে শহীদ দিবস উপলক্ষে আলোচনাসভা, সেমিনার, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আবৃত্তি, নান্দনিক হস্তাক্ষর লেখা প্রতিযোগিতা, রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে বায়তুল মোকাররম চত্বরে গ্রন্থমেলার আয়োজন করা হবে।
সকল জেলা ও উপজেলা সদরে দিবসটি পালনের লক্ষ্যে জাতীয় কর্মসূচীর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করা হবে। বিদেশে অবস্থিত মিশনগুলোতে শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস যথাযথভাবে উদযাপিত হবে।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে রাত ১২টা ১ মিনিটে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ, সকাল সাড়ে ৬টায় সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যালয় বঙ্গবন্ধু ভবনসহ সংগঠনের সকল শাখা কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ ও কালো পতাকা উত্তোলন। সকাল ৭টায় কালো ব্যাজ ধারণ করে নিউ মার্কেটের দক্ষিণ গেট থেকে নগ্নপদে প্রভাত ফেরি সহকারে আজিমপুর কবরস্থানে শহীদদের কবরে ও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের মধ্য দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন।
এ ছাড়াও মহান শহীদ দিবস উপলক্ষে আগামী ২২ ফেব্রুয়ারি বিকেল ৩টায় খামারবাড়ি কৃষি ইনস্টিটিউটে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হবে। এতে প্রধান অতিথির ভাষণ দেবেন দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
একুশের চেতনার ফসল হিসেবে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে শহীদ মিনার গড়ে উঠে। প্রতিটি শহীদ মিনার যেন ভাষা শহীদদের অগ্নিশিখা। মাতৃভাষাকে কেবল অসৎ অভিসন্ধির হাত থেকে রক্ষা করেই এ দেশের মানুষ ক্ষান্ত হয়নি, তার জাতিসত্তার পরিচয়কে সাহিত্যের প্রতিটি ক্ষেত্রে এবং শিল্পকর্ম, সঙ্গীত ও নৃত্যে আরও সমৃদ্ধতর করে বাঙালী মননশীলতাকে গতিময় করে তোলে।
ভাষা আন্দোলন তথা একুশে ফেব্রুয়ারি একটি চেতনার নাম। যে চেতনা আমাদের বাঙালী জাতিসত্তার বিকাশ এবং জাতির মেধা, মনন ও সৃজনশীলতার পথকে বিস্তৃত করেছে। ভাষা আন্দোলনের প্রভাবে সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলাসহ সৃষ্টিশীলতার প্রতিটি ক্ষেত্রে গুণগত ও পরিমাণগত পরিবর্তন সাধিত হয়েছে।
আমাদের জাতীয় চেতনা বিকাশেও ভাষা আন্দোলনের অবদান অনস্বীকার্য। ভাষা আন্দোলন তার বহুমাত্রিক চরিত্র নিয়ে আমাদের জাতীয় জীবনে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। বাংলা একাডেমি ভাষা আন্দোলনেরই ফসল। বাংলা একাডেমি তাই জাতির মননের প্রতীক হয়ে উঠেছে। জাতীয় আশা-আকাক্সক্ষার সঙ্গে সঙ্গতি বজায় রেখে ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক গুরুত্বকে বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্ম এবং বিশ্বের কাছে তুলে ধরার মূল দায়িত্ব বাংলা একাডেমির। তাই বাংলা একাডেমি ভাষা আন্দোলন জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করেছে।
মহান শহীদ দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মহিলা যুবলীগ, কৃষক লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, জাতীয় শ্রমিক লীগ, ছাত্রলীগ, বিএনপি, গণফোরাম, জাতীয় পার্টি, গণআজাদী লীগ, বাসদ, বাংলা একাডেমি, নজরুল একাডেমি, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, খেলাঘর, জাতীয় প্রেসক্লাব, ডিইউজে, বিএফইউজে, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল, মুক্তিযোদ্ধা সংসদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন বিস্তারিত কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। একই সঙ্গে ভাষা শহীদদের স্মরণে বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন নানা কর্মসূচী হাতে নিয়েছে। বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, অপরাজেয় বাংলা, জাকের পার্টি, খিলগাঁও মডেল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, ঢাকা বিভাগ শ্রমিক লীগ, ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ, জয়বাংলা সাংস্কৃতিক ঐক্যজোট, জুরাইন নবতরুণ সংঘ পাঠাগার, গ্রীন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ ও মুক্তিযোদ্ধা কমিউনিজম ডেমোক্র্যাটিক পার্টি মহান ২১ ফেব্রুয়ারিতে নানা কর্মসূচী পালন করবে।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button