মাদারিপুরে ৫০ বছর পর মাকে খুঁজে পেলেন এলিজাবেথ ফিরোজা!
প্রবাহ রিপোর্টঃ ১৯৭৫ সালে ১৩ বছর বয়সী কিশোরী ফিরোজা বেগম তখন বিবাহিতা। সন্তান পেটে আসার পর স্বামীকে হারান তিনি। স্বামীর মৃত্যুর পর দিশেহারা হয়ে পরেন। ওদিকে নিজের বাবাও মারা গেছেন। এরই মধ্যে ১৫ জুলাই সকালে জন্ম হয় কন্যাশিশু। সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে ভুলে থাকতে চেষ্টা করেন সব দুঃখ-কষ্ট! কিন্তু বাস্তবতার সাথে মিলে না অনেক কিছুই। অনিশ্চয়তা নিয়েই ফুটফুটে সন্তানের নাম রাখেন মৌসুমী। সন্তানকে মানুষ করার চিন্তায় তখন দিশেহারা ফিরোজা বেগম। মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন খাদ্যের জন্য। সন্তানকে নিয়ে বেঁচে থাকতে একটু সাহায্যের জন্য। কিন্তু ব্যর্থ হন তিনি। এক প্রতিবেশীর পরামর্শে ১৯৭৫ সালের ৩০ আগষ্ট ঢাকায় সমাজসেবা অধিদপ্তরের শিশু সদনে বিনা শর্তে শিশুটিকে দিয়ে দেন ফিরোজা বেগম। আর কখনো পেটের সন্তানের সাথে দেখা হবে না তার। নির্মম সত্য জেনেই শিশু সদনে সন্তান রেখে ফিরে এসেছিলেন তিনি। দীর্ঘ ৫০ বছর পর ওই সন্তান তার মাকে খুঁজে বের করেছেন। মায়ের কাছে এসেছেন। মাকে জড়িয়ে ধরে মায়ের শরীরের ঘ্রাণ নিয়েছেন। সন্তানকে ফিরে পেয়ে বাকরুদ্ধ তখন মা ফিরোজা বেগমও। ৫০ বছর আগে সন্তানকে হাতছাড়া করার দুঃসহ স্মৃতি ভাসতে থাকে তার মানসপটে! বৃহস্পতিবার (২৮ মার্চ) মা-মেয়ের অভূতপূর্ব এই মিলন ঘটে মাদারীপুর জেলার শিবচরের মাদবরেরচর ইউনিয়নের পোদ্দারচর এলাকার ফিরোজা বেগমের নিজ বাড়িতে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নরওয়ের আরেন্ডাল শহরে স্বামী হেনরিক ফাজালসেট আর চার সন্তান নিয়ে বাস করেন প্রায় ৫০ বছর বয়সী এলিজাবেথ ফিরোজা ফাজালসেট। বাংলাদেশ থেকে ১৯৭৫ সালে নরওয়ের রয়-রেড দম্পতি তাকে দত্তক হিসেবে নিয়ে যান। মৌসুমী নাম থেকে তার নাম হয়ে যায় এলিজাবেথ। সেখানেই বেড়ে উঠা,জীবনযাপন। তিনি পেশায় একজন স্বাস্থ্যকর্মী। স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখের জীবন হলেও জন্মদাত্রী মায়ের জন্য হাহাকার ছিল তার বুকে! বড় হওয়ার পর এলিজাবেথ জানতে পারেন তার প্রকৃত বাবা-মা বাংলাদেশি। তবে জানেন না কে তার মা-বাবা। শুধু জানতেন মায়ের নাম ফিরোজা বেগম আর বাবা মৃত বশির সরদার। জন্ম হয়েছিল বাংলাদেশের ঢাকায়। আর এই তথ্যও সে পেয়েছে প্রথম পাসপোর্ট আর নরওয়ের দত্তক নেওয়া পরিবারের কাছে থাকা দলিল থেকে। এর পর থেকেই নিজের নামের শেষে ফিরোজা নামটি যুক্ত করেন এলিজাবেথ। দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে বৃহস্পতিবার (২৮ মার্চ) সকালে মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার মাদবরচর ইউনিয়নের পোদ্দার চর গ্রামের সরদার বাড়িতে দেখা মিলে মা-মেয়ের। দীর্ঘ ৫০ বছর পর হারানো মেয়েকে পেয়ে বুকে জড়িয়ে রাখেন মা ফিরোজা বেগম। আর জন্মদাত্রী মাকে পেয়ে আবেগ-আপ্লুত হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন মেয়ে এলিজাবেথ ফিরোজা ওরফে মৌসুমী! মায়ের জন্য নরওয়ে থেকে নতুন জামা-পায়জামা, কসমেটিক্সসসহ বিভিন্ন উপহার নিয়ে আসেন তিনি। বাড়িতে এসে নিত্য প্রয়োজনীয় সব বাজার করে দেন তিনি। আর নরওয়ে থেকে মাকে যেন দেখতে পারেন, এজন্য কিনে দেন একটি স্মার্টফোনও। এলিজাবেথের বাংলা না জানায় কেউ কারো মুখের কথা বুঝতে না পারলেও আবেগ-অনুভূতি দিয়েই ভাবের আদান-প্রদান করেন তারা। এলাকাবাসী জানান, পোদ্দার চর গ্রামের মৃত বছির সরদারের স্ত্রী ফিরোজা বেগম ঢাকা বসবাস কালে ১৯৭৫ সালের ১৫ জুলাই ঢাকায় ননদের বাসায় এক কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। নাম রাখেন মৌসুমী। সেই সময় ফিরোজা বেগমের আর্থিক অভাব অনটন ও শারীরিক অসুস্থতার কারণে মৌসুমী নামের নবজাতককে মোহাম্মাদপুরের সমাজ কল্যান পরিচালককের কাছে দত্তক দেনন। ওই সময় আন্তঃদেশ শিশু দত্তক এর তৎকালীন সমাজ সেবিকা রওশন জাহান শিশুটিকে (মৌসুমীকে) গ্রহণ করেন। এলিজাবেথের মা ফিরোজা বেগম জানান, ওর বাবা যখন মারা যায় তখন আমি দিশেহারা হয়ে পড়ি। আত্মীয়-স্বজন অনেকের বাড়ি বাড়ি ঘুরেছি। কোনো কুল-কিনারা পাই নাই। কিন্ত কোলের মানিক রাস্তায় ফেলে আসিনি। রেখেছি সরকারের কাছে। বেঁচে থাকলে একদিন দেখা পাবোই, এই আশায়। আল্লাহ আমার আশা পূরণ করেছেন। যে বিশ্বাসে রেখে এসেছিলাম, ৫০ বছর পর তা সত্যি হলো!’এলিজাবেথ ফিরোজা জানান, ছোটবেলা থেকে নরওয়ে বড় হয়েছি। সেখানের বাবা-মা নাম রাখেন এলিজাবেথ। বড় হয়ে জানতে পারি আমার জন্ম বাংলাদেশে। মায়ের নাম ফিরোজা বেগম। তারপর থেকেই আমি ফিরাজো নামটাকে আমার নামের সঙ্গে যুক্ত করি। তবে ২২ বছর বয়সে প্রথম সন্তান প্রসবের পর চিকিৎসক আমার হিস্টিরি জানতে চান। তখন থেকেই নিজের পরিবারকে খুঁজে পেতে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়। আমার স্বামী হ্যানরি ও আমার সন্তানেরা আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। আমার তিন ছেলে ও এক মেয়ে এবং নাতিনও আছে। এবার আমার জন্মদাত্রী মাকেও ফিরে পেলাম! আমি আনন্দিত ভীষণ!