জাতীয় সংবাদ

ক্রশশঃ দূর্বল হচ্ছে উপকূলীয় অঞ্চলের বেড়িবাঁধগুলোর

প্রবাহ রিপোর্ট : পানিতে লবণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে মাটির কণা একে অন্যের সঙ্গে আঁকড়ে ধরে রাখার ক্ষমতা হারাচ্ছে। ফলে ভাঙন বাড়ছে সেসব এলাকা রক্ষার জন্য নির্মিত বাঁধগুলোর। এছাড়া আরও বেশকিছু কারণে উপকূলের বেড়িবাঁধ সামান্য জোয়ারের পানিতে ভেঙে যায়। সেগুলো হচ্ছে-ষাটের দশকের ডিজাইনে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা, তড়িঘড়ি করে বাঁধ নির্মাণ, রোলার দিয়ে ভালোভাবে মাটি না দাবিয়ে বাঁধ তৈরি, বাঁধে ইঁদুরের গর্ত খোঁড়া, হতদরিদ্র ছিন্নমূল মানুষ বেড়ির ঢালে ঘর-দরজা নির্মাণ করা এবং প্রভাবশালীরা বেড়িবাঁধের নিচ দিয়ে পাইপ ঢুকিয়ে নদী থেকে বালু উত্তোলনের পর সৃষ্ট ছিদ্র ভরাট না করা। এছাড়াও রয়েছে তদারকির জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের জনবল সংকট, ডিজিটাইজেশনের ছোঁয়া না লাগা, মেরামত বা রক্ষণাবেক্ষণ খাতে বরাদ্দ না থাকা, জমি অধিগ্রহণের সমস্যা এবং বেড়িবাঁধের এপার-ওপারের মানুষের মধ্যে রেষারেষির কারণে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে বাঁধ ছিদ্র করে দেওয়া। উপরন্তু বেড়িবাঁধ কাজের গুণগত মান নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলী, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেড়িবাঁধের মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিতে দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট অঞ্চলের বাঁধগুলো। গত দেড় দশকে এসব এলাকায় বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারে শত শত কোটি টাকা ব্যয় করা হলেও তার সুফল মেলেনি। আর আড়াই হাজার কোটি টাকার দুটি মেগাপ্রকল্পসহ বেশ কয়েকটি প্রকল্প চলমান থাকলেও বাস্তবায়নকাজ চলছে ধীরগতিতে। এদিকে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, দেশের বেড়িবাঁধের বর্তমান ডিজাইন ষাটের দশকের। তখনকার তুলনায় বর্তমানে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস আরও ক্ষীপ্রগতিতে আঘাত হানছে। প্রকৃতির গতিপ্রকৃতির পরিবর্তন হলেও বেড়িবাঁধের ডিজাইন আধুনিকায়ন হয়নি। আনা হয়নি কোনো ধরনের পরিবর্তন। ফলে একটু বেশি জোয়ার হলেই বাঁধ ভেঙে স্বপ্নভঙ্গ হচ্ছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, আগে বেড়িবাঁধে ৬ মাস সময় নিয়ে মাটি ভরাট করা হতো। বিশেষ করে ডিসেম্বরে মাটি ভরাট শুরু হতো, শেষ হতো জুনে। প্রায় ৬ মাস মাটি ভরাটের ফলে মাটি স্বাভাবিক নিয়মে ভালোভাবে বসে শক্ত বাঁধ তৈরি হতো। এখন বেড়িবাঁধের টেন্ডারে সর্বোচ্চ ৩ মাস বা ৯০ দিন সময় দেওয়া হয়। অনেক সময় আরও কম সময়ে বর্ষার মধ্যে জরুরি ভিত্তিতে বেড়িবাঁধের কাজ করতে হয়। এতে কাজের মান বলে কিছু থাকে না। ফলে সামান্য জোয়ারের পানিতে ভেঙে যায় বাঁধ। তারা আরও জানান, তৈরি বেড়িবাঁধ রক্ষণাবেক্ষণে পর্যাপ্ত বরাদ্দ নেই। দেখভালের জন্য নেই কোনো জনবল। বেড়িবাঁধ তৈরির পর ইঁদুর গর্ত খুঁড়ে, অন্যান্য প্রাণীও গর্ত তৈরি করে, ছিন্নমূল মানুষ বেড়িবাঁধের ঢালুতে ঘর তৈরি করে বসবাস করে। অনেকে বেড়িবাঁধের ওপর নানা ধরনের গাছ, শাকসবজি আবাদ করে। এসব দেখভালে উপজেলা পর্যায়ে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বা পানি উন্নয়ন বোর্ডের একজন জনবলও নেই। জেলা পর্যায়ে নির্বাহী প্রকৌশলী ও জোনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর কার্যালয় থেকে ইউনিয়ন কিংবা উপজেলা পর্যায়ের বেড়িবাঁধ রক্ষণাবেক্ষণ করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তাছাড়া বিভিন্ন কারণে বেড়িবাঁধের যে ক্ষতি সাধিত হয়, তা মেরামতের জন্য পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোনো বরাদ্দ নেই। ফলে বেড়িবাঁধ তৈরির পর তা আছে কি নেই, তাও অনেক ক্ষেত্রে বলতে পারেন না সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। শুধু বন্যার কারণে কোথাও পানি ঢুকে বড় ধরনের কোনো ক্ষতি সাধিত হলে কয়েকদিন আলোচনা-সমালোচনা হয়। তারপর যেই-সেই অবস্থা। তখন কারও আর মাথাব্যথা থাকে না। এ ছাড়া ডিজিটালি অফিসে বসে বাঁধের বর্তমান অবস্থা মনিটরিং করার কোনো ব্যবস্থা নেই। মনিটরিং পদ্ধতি আধুনিকায়ন করা হয়নি। সংশ্লিষ্টরা জানান, বেড়িবাঁধের মাটি রোলার দিয়ে ভালোভাবে চাপা দেওয়া হয় না। পাউবির কাজের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলার কেউ থাকে না। কারণ, যে এলাকায় বেড়িবাঁধ তৈরি করা হয়, ওই এলাকার সংসদ-সদস্যের লোকরা বেড়িবাঁধের মাটি ভরাটের কাজ পায়। সুতরাং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা কাজের গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো নজির নেই। বরং ঠিকাদার কাজ না করে বিল নিতে চাইলে তা আটকে গেলে সেই বিল ছাড়করণের তদবির নিয়ে আসেন কোস্টাল বেল্টের সংসদ-সদস্যরা। এমন পরিস্থিতিতে করণীয় নির্ধারণে গণশুনানির নির্দেশনা দিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এ বিষয়ে পানিসম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, উপকূলের বেড়িবাঁধ নিয়ে এরইমধ্যে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও পানি উন্নয়ন বোর্ড পর্যায়ে নয়, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনার পর বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তিনি আরো বলেন, একবার জনগণ বাঁধ দেওয়ার দাবি জানাবে, আবার বলবে বাঁধটি সরিয়ে দাও, সেটা হবে না। এ ছাড়া অনেক জায়গায় বোঝারও ভুল থাকতে পারে। তাই আমাদের নীতিগত মন্ত্রণালয় ও বোর্ড পর্যায়ে আর সিদ্ধান্ত হবে না। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর কথা শুনেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এজন্য একটা গণশুনানি করতে হবে।

 

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button