রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক প্রধান উপদেষ্টার : ৩ বিষয়ে চেয়েছেন পরামর্শ
প্রবাহ রিপোর্ট : দেশে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে তিন বিষয়ে পরামর্শ চেয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল বুধবার বিকাল সোয়া পাঁচটায় বৈঠক চলাকালীন অবস্থায় ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমি থেকে বের হয়ে আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) যুগ্ম সদস্য সচিব আসাদুজ্জামান ফুয়াদ সাংবাদিকদের এ কথা জানান। এ সময় বৈঠকের এজেন্ডা সরকারের পক্ষে শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান তুলে ধরেন বলেও জানান তিনি। আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেন, ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তিনটি বিষয়ে আলোচনা করছেন প্রধান উপদেষ্টা। বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে- ভারতসহ সারা বিশ্বে যে প্রপাগান্ডা চলছে সেগুলোর বিষয়ে রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের করণীয়, আগরতলায় সহকারী হাইকমিশন অফিস ভাঙচুর ও পতাকা অপমান করা নিয়ে করণীয় এবং বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে যে গল্প ও উপন্যাস সারা দুনিয়ায় চলছে তা নিয়ে মতামত। এদিন বৈঠকে নির্বাচন বিষয়ে কোনও আলোচনা রাখা হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, সব দল তাদের মতামত তুলে ধরছে, রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের করণীয় কী। এখন পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে যে আলোচনা হয়েছে তা হলো- বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল আলোচ্যসূচিতে নির্বাচন না থাকলেও প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে নির্বাচন দেওয়ার জন্য তাগাদা দেয়। স্বরাষ্ট্র এবং অন্যান্য কিছু মন্ত্রণালয়ের ক্ষেত্রে অনেকে সেবার একটা ঘাটতি বোধ করছেন, এক্ষেত্রে সরকার কী ব্যবস্থা নেবে। সবাই রাষ্ট্রকে আশ্বস্ত করেছেন, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে এবং জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে আমরা আপনাদের পেছনে আছি। আপনাদের সিদ্ধান্ত ও লড়াইয়ের পেছনে আমরা অংশীদার। এবি পার্টির যুগ্ম সদস্য সচিব বলেন, বৈঠকে একজন সাবেক মিলিটারি অফিসার, যিনি একটি দলেরও প্রধান, তিনি ভারতের সঙ্গে উসকানি ও উদ্বেগের জায়গা থেকে কীভাবে ভারসাম্যের জায়গায় নিয়ে আসা যায় তার জন্য কাজের পরামর্শ দেন। দুই-একজন পরামর্শ দিয়েছেন সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে একটি জাতীয় কমিশন করা যায় কিনা। জাতীয় কমিশন করলে ৫০ বছরের বঞ্চনা, বিশেষ করে গত ১৬ বছরে যে বঞ্চনা হয়েছে তার সত্যতা কতটুকু, তা বের হয়ে আসবে- এমন মতামতও কেউ কেউ দিয়েছেন বলে জানান ফুয়াদ। তিনি বলেন, কিছু মতামত এসেছে, বিভিন্ন রাষ্ট্রে যেসব অ্যাম্বাসি আছে, সেখানে যারা কর্মরত তারা এখনও ফ্যাসিবাদী আমলের। তাই ওইসব রাষ্ট্রে বাংলাদেশ-বিদ্বেষ ঠেকানোর জন্য যা যা করা দরকার তা করছে না। সেক্ষেত্রে দূতাবাসগুলো থেকে তাদের বের করে এনে অভ্যুত্থানের পক্ষের অফিসারদের নিয়োগ করা দরকার। একইসঙ্গে চলমান প্রপাগান্ডা নিয়ন্ত্রণের জন্য রাষ্ট্রের পিআর সেল করা দরকার বলে কিছু রাজনৈতিক দল মতামত দিয়েছে বলেও জানান এবি পার্টির যুগ্ম সদস্য সচিব।
শেখ হাসিনা সরকার সবকিছু ধ্বংস করে গেছে, নিক্কেই এশিয়াকে ড. ইউনূস
প্রবাহ রিপোর্ট : ‘ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকার সবকিছু ধ্বংস করে গেছে’ উল্লেখ করে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বলেছেন, নির্বাচনের আগে আমাদের অর্থনীতি, শাসনব্যবস্থা, আমলাতন্ত্র ও বিচারব্যবস্থায় সর্বাত্মক সংস্কার করতে হবে। গত শনিবার জাপানি সংবাদমাধ্যম নিক্কেই এশিয়াকে দেওয়া এক একান্ত সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা এসব কথা বলেন। সম্পতি সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনি ব্যবস্থা, সংবিধান এবং বিচার ব্যবস্থার ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য বেশ কয়েকটি কমিশন গঠন করেছে। জানুয়ারির মধ্যে ওই কমিশনগুলোর সুপারিশ হাতে পাওয়ার পর পূর্ণাঙ্গ সংস্কার বাস্তবায়ন করার কথা জানান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তবে এই সংস্কার বাস্তবায়নে সময় লাগবে বলে জানান তিনি। উপদেষ্টা বলেন, এই সংস্কার বাস্তবায়নে সময় লাগবে, কেননা ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়তে আমরা একদম শূন্য থেকে শুরু করেছি। নির্বাচন ঠিক কখন হবে সে বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেছেন, নির্বাচনের সময় নির্ভর করছে সংস্কার প্রক্রিয়ার ওপর। এর ফলাফলই সময় নির্ধারণ করে দেবে। সাধারণ নির্বাচনে ড. ইউনূস প্রার্থী হবেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি নাকচ করে দিয়ে বলেন, না, আমি রাজনীতিবিদ নই। আমি সবসময়ই রাজনীতি থেকে দূরে থেকেছি। রাষ্ট্রের যেসব ব্যক্তি নীতি-নৈতিকতা সমুন্নত রাখেন, নিয়মকানুন মেনে চলেন এবং নিজেকে দুর্নীতিমুক্ত রাখেন তাদেরই নির্বাচনে দাঁড়ানো উচিত বলে মনে করেন ড. ইউনূস। তিনি বলেন, হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে দেশের শাসনকাঠামো পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে, আর গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করে তা পুনর্গঠনের সুবিশাল কর্মযজ্ঞ আমাদের ঘাড়ে এসে পড়েছে। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, হাসিনার শাসনামলে গণতন্ত্রের রীতিনীতি একদম ধ্বংস হয়ে গেছে। টানা তিন মেয়াদে ভোটারবিহীন ভুয়া নির্বাচন মঞ্চস্থ করেছেন হাসিনা। আর তাতে তিনি নিজেকে এবং তার দলকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী ঘোষণা করেছেন। একজন ফ্যাসিবাদী শাসক হিসেবে এসব করেছেন হাসিনা। ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, এ বছরের আগস্টে ছাত্রনেতৃত্বাধীন সরকারি চাকরিতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে কয়েক শ’ শিক্ষার্থী নিহত হন। এরপরই শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন হাসিনার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়। শেষ পর্যন্ত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে হাসিনার ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। তিনি হেলিকপ্টারে চড়ে ভারতে পালিয়ে যান। অক্টোবরে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনা এবং তার বেশ কয়েকজন সহযোগীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। এই বিচারিক কার্যক্রম শেষে রায় হলে হাসিনার প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে ভারতকে অবহিত করা হবে বলে জানান ড. ইউনূস। তিনি বলেন, বিচার শেষে তার বিরুদ্ধে চূড়ান্ত রায় এলে আমরা ভারতের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে হাসিনাকে হস্তান্তরের অনুরোধ জানাবো। এক্ষেত্রে উভয় দেশের স্বাক্ষরিত একটি আন্তর্জাতিক আইনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভারত এ আইন মেনে কাজ করতে বাধ্য হবে। কূটনৈতিক ফ্রন্টে বাংলাদেশের ভারতের সঙ্গে শক্তিশালী ও সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা উচিত। এক্ষেত্রে ড. ইউনূস দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) পুনরুজ্জীবনের প্রস্তাব করেছেন। ভারত ও পাকিস্তানের বৈরী সম্পর্কের ফলে সার্ক কার্যত নিষ্ক্রিয় রয়েছে। সার্কের লক্ষ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে- ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলোর মতো নিজেদের মধ্যে চলাফেরার স্বাধীনতা, আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য উৎসাহিত করা। সার্কের সম্ভাবনার কথা তুলে ধরে ভারতকে পাকিস্তানের সঙ্গে উত্তেজনা নিরসনের আহ্বান জানান ড. ইউনূস। এদিকে হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে ভারত। তাদের দাবি বাংলাদেশে হিন্দুদের ঘরবাড়ি, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও মন্দিরে ‘হামলা’ করা হয়েছে। এ বিষয়ে ঢাকাকে অবশ্যই হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে বলে জোর দিয়েছে দিল্লি। তবে ভারত সরকারের এসব ঢালাও বক্তব্য নাকচ করে দেন ড. ইউনূস। তিনি বলেন, সংখ্যালঘু ইস্যুতে যা বলা হচ্ছে তার বেশির ভাগই প্রোপাগান্ডা। এগুলো সঠিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বলা হচ্ছে না বলে পাল্টা অভিযোগ করেন ড. ইউনূস। তিনি ভারতীয় সাংবাদিকদের বাংলাদেশে এসে তদন্তসাপেক্ষে সঠিক তথ্য তুলে ধরার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আমরা এসব অপ-তথ্যের বিরুদ্ধে ভারত সরকারকে ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য কাজ করছি। অন্য আঞ্চলিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইউনূস চীনকে বাংলাদেশের ‘বন্ধু’ বলেও অভিহিত করেন। তিনি বলেন, সড়ক ও বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ থেকে শুরু করে সমুদ্রবন্দর পর্যন্ত তারা আমাদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করছে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ বেইজিংয়ের সঙ্গে সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে। দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর সংস্থা- আসিয়ানে বাংলাদেশের যোগ দেওয়ার বিষয়ে জোর দেন ড. ইউনূস। বাংলাদেশ আসিয়ানে যোগ দেওয়াকে একটি প্রতিশ্রুতিশীল সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করতে চায়। কারণ বাংলাদেশ বিশেষ করে ২০২৬ সালে জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে, এরপর বাংলাদেশ আর অগ্রাধিকারভিত্তিক শুল্ক সুবিধা পাবে না। মালয়েশিয়া আগামী জানুয়ারি থেকে আসিয়ানের সভাপতি হতে যাচ্ছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ড. ইউনূস বলেন, তিনি মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে বাংলাদেশের সদস্যপদ নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি বাংলাদেশকে আসিয়ানে স্বাগত জানাতে তার সদিচ্ছার কথা ব্যক্ত করেছেন। তবে এক্ষেত্রে বেশ কিছু ধাপ রয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। তিনি বলেন, বাংলাদেশের আসিয়ানে যোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রথম ধাপটি হবে সংস্থাটির সংজ্ঞা সংশোধনে একটি সর্বসম্মত রেজোল্যুশন নিশ্চিত করা। এর আগে আমরা আসিয়ানের একটি সেক্টরাল ডায়ালগ পার্টনার হিসেবে স্বীকৃতি অর্জনের আশা করছি। আসিয়ানের সদস্য দেশগুলো বাংলাদেশের এই প্রচেষ্টাকে সমর্থন করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন ড. ইউনূস। মিয়ানমারের সামরিক জান্তার দমন-পীড়ন থেকে বাঁচতে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া বিপুল সংখ্যক রাষ্ট্রবিহীন ও নাগরিকত্বের প্রাধিকার-বঞ্চিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী প্রসঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এই দায় (রোহিঙ্গা) বাংলাদেশ কতদিন বহন করবে? রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আমাদের একটি সুস্পষ্ট গন্তব্য ও একটি অভিন্ন লক্ষ্য ঠিক করা দরকার। বাংলাদেশ মিয়ানমারে জাতিসংঘ-শাসিত একটি নিরাপদ অঞ্চল প্রতিষ্ঠার পক্ষে প্রচার চালাচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এতে করে এই বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা তাদের দেশেই আশ্রয়-শিবিরে থাকতে পারবে। সেখানকার পরিস্থিতি স্থিতিশীল হলে তাদের অন্য কোনও দেশে স্থানান্তর করার প্রয়োজন হবে না, তারা তাদের নিজেদের বাড়িঘরে ফিরে যেতে পারবে বলে উল্লেখ করেন মুহাম্মদ ইউনূস।