শিগগির জুলাই ঘোষণাপত্র, গণহত্যার বিচার ও নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি নাহিদের

প্রবাহ রিপোর্ট ঃ অবিলম্বে জুলাই ঘোষণাপত্র, গণহত্যার বিচার ও নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, দেশে একটি অনিশ্চিয়তা ও অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়েছে। সংকট উত্তোরণে ফ্যাসীবাদবিরোধী সব রাজনৈতিক দলের ঐক্য জরুরি। শনিবার দুপুর সাড়ে ১২টায় বাংলামোটরে এনসিপির অস্থায়ী কার্যালয়ে সমসাময়িক পরিস্থিতি নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। নাহিদ ইসলাম বলেন, দেশের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে সবাইকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের দায়বদ্ধতা রয়েছে। গণহত্যার বিচার ও মৌলিক সংস্কার করতে হবে। আমরা মনে করি শুধু ভোটের জন্য জুলাই গণঅভ্যুত্থান হয়নি। যাদের যে দায়িত্ব তারা যেন সেটা পালন করেন মন্তব্য করে এনসিপির আহ্বায়ক বলেন, সেনবাহিনী সম্প্রতি ৬২৬ জনের যে তালিকা প্রকাশ করেছে তা আরও আগেই হওয়া উচিত ছিল। তা হলে এতো কথা হতো না। সেনাবাহিনী হলো স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। তিনি বলেন, বিগত সরকারের সময় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অনেক কর্মকর্তা অন্যায়ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তাদেরসহ গুম-খুনে জড়িতদের বিচার করতে হবে। নাহিদ ইসলাম বলেন, আওয়ামী আমলের সব নির্বাচন অবৈধ। তাই সেসব নির্বাচনের প্রতিনিধি হতে যারা আন্দোলন করেন, তাদের বিষয়টি জনগণ ইতিবাচক হিসেবে নেয়নি। তৃণমূল মানুষের সেবা নিশ্চিতে আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হওয়া দরকার। নির্বাচন কমিশনকে আস্থার জায়গায় ফিরতে হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। সরকারে থাকা দুই ছাত্র উপদেষ্টার সঙ্গে এনসিপির কোনো রাজনৈতিক সম্পর্ক নেই। তারা গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে আহত ও শহীদ পরিবারের স্বার্থ আদায়ে তখন সরকারে যোগ দেন। এখন তাদের এনসিপির প্রতিনিধি বলে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। আমাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য, তারা রাজনীতি করতে চাইলে আগে পদত্যাগ করতে হবে। যেমনটি আমি করেছি। নাহিদ বলেন, বারবার দেশকে অনৈক্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত। ৫ আগস্টের পর থেকেই তারা এ কাজটি করে আসছে। মূলত আওয়ামী লীগ তাদের দিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে। তিনি বলেন, জাতীয় নাগরিক পার্টি সব সময় ঐক্যের কথা বলেছে। বিএনপি সব সময় নির্বাচনের কথা বলেছে। কিন্তু নির্বাচনই মূল কথা নয়। আমাদের কাছে দেশের স্বার্থ আগে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে নাহিদ বলেন, প্রধান উপদেষ্টা বলেছিলেন মৌলিক সংস্কার ও বিচার করে নির্বাচন দেবেন। কিন্তু যমুনাসহ বিভিন্ন আন্দোলন নিয়ে তিনি অসন্তোষ প্রকাশ থেকে পদে না থাকার কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এ পরিস্থিতি চলমান থাকলে এবং একটি নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন না হলে এর দায়ভার নিতে চান না। এনসিপিরি এই নেতা বলেন, ওয়ান-ইলেভেনের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক বিষয়ে কথা না বলার আহ্বান জানান তিনি। সরকারের কাজে সন্তুষ্ট কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে নাহিদ বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের বিচার ও সংস্কার বিষয়ে যে গতিতে কার্যক্রম চলছে, আমরা (এনসিপি) তাতে সন্তুষ্ট নই। এ নিয়ে আমাদের সমালোচনা রয়েছে, তবে সহযোগিতাও রয়েছে। আমরা আমাদের দাবিগুলো নিয়ে রাজপথে আছি, সরকারকে চাপও দিচ্ছি, তবে সেটি দেশ ও জনগণের স্বার্থে। সরকারকে আমরা বাধাগ্রস্ত করছি না। আমরা চাই, কোনো পক্ষই সরকারের কাজে বাধা হয়ে না দাঁড়াক। সমালোচনা হোক, সহযোগিতাও হোক-সরকার যেন কাজের গতি বাড়ায় এবং জনগণের সামনে তা আরও স্পষ্ট করে তুলে ধরে। তিনি আরও বলেন, আমরা একটি নতুন সংবিধান চাই। সেটার জন্য গণপরিষদ নির্বাচন চাই। মৌলিক সংস্কারের জন্য আমরা ‘জুলাই সনদ’ চাই, আমরা বিচার চাই। কিন্তু বিএনপি শুধু নির্বাচনের কথাই বলেছে। একটি জাতীয় নির্বাচনই গণঅভ্যুত্থানের পর আমাদের একমাত্র আকাঙ্ক্ষা নয়। ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা আমাদের অন্যতম চাওয়া, কিন্তু একমাত্র নয়। রাজনৈতিক মতামত, ভিন্নমত, আদর্শ থাকতেই পারে; কিন্তু দেশ ও জনগণের স্বার্থে আমাদের ঐক্যের জায়গায় যেতে হবে- আমরা এটা বিশ্বাস করি। আমরা যে কোনো সময় আলোচনার জন্য প্রস্তুত। ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্পর্কে তিনি বলেন, যে ধরনের পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছিল-আদালত, এনবিআর, যমুনা-এই প্রেক্ষাপটে তিনি মনে করছেন, তাকে জিম্মি করে দাবি আদায় সম্ভব নয়। তিনি দায়িত্ব নিয়েছেন দেশের মৌলিক পরিবর্তনের জন্য। কিন্তু বিচার ও সংস্কারের কাজগুলো যদি তিনি করতে না পারেন, তাহলে ওনার দায়িত্ব পালনের যৌক্তিকতা থাকে না। রাজনৈতিক দলগুলো যদি এভাবে চলতে থাকে, তাহলে তার পক্ষে দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়। তিনি নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তবে আমরা বলেছি, তাকে দায়িত্বে থাকতে হবে। জনগণের কাছে তার প্রতিশ্রুতি রয়েছে। তাই তিনি যেন রাজনৈতিকভাবে বিষয়টি সমাধান করেন এবং সব দলকে ঐক্যের দিকে আহ্বান জানান। তিনি বলেন, এক-এগারোর বন্দোবস্ত মানে ছিল সেনাসমর্থিত ও বিদেশি প্রভাবের একটি সরকার, যা গণতন্ত্রবিরোধী। আমরা ৫ আগস্ট থেকে বলে আসছি, গণঅভ্যুত্থনের সমর্থনে জনগণের সরকার হতে হবে, যারা গণতন্ত্র ও সংস্কার নিশ্চিত করবে। সেনাবাহিনীর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা আছে, তারা একটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। কিন্তু রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত তাদের কাজ নয়। তিনি আরও বলেন, আমরা গণপরিষদ ও আইনসভার নির্বাচন চাই, যেটা নতুন সংবিধান ও রাজনৈতিক ট্রানজিশন নিশ্চিত করবে। বর্তমানে স্থানীয় সরকার নিয়ে আদালতের রায় এবং তা ঘিরে আন্দোলন ও বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে। তাই আমরা মনে করি, দ্রুত নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন করা উচিত। প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে ডিসেম্বর-জুন টাইমফ্রেম দেওয়া হয়েছে জাতীয় নির্বাচনের জন্য, আমরা সেটি সমর্থন করি। তবে তার আগে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’, বিচার ও সংস্কার নিশ্চিত করতে হবে। নাহিদ ইসলাম বলেন, সরকারে থাকা দুই ছাত্র উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার সঙ্গে এনসিপির কোনো রাজনৈতিক সম্পর্ক নেই। তারা গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে আহত ও শহীদ পরিবারের স্বার্থ আদায়ে সরকারে যোগ দেন। নাহিদ ইসলাম বলেন, দুই ছাত্র উপদেষ্টাকে কেউ কেউ এনসিপির প্রতিনিধি বলে অপপ্রচার চালাচ্ছেন। আমাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য, তারা এনসিপির কেউ নন। তিনি বলেন, তারা রাজনীতি করতে চাইলে আগে পদত্যাগ করতে হবে। যেমনটি আমি করেছি। এখন তারা তাদের পরবর্তী স্ট্র্যাটেজি কী করবেন এ নিয়ে আমাদের বলার কিছু নেই। এসময় এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার পাঁচ বছর থাকবে না কত বছর থাকবে এটা তাদের বিষয়। এর সঙ্গে এনসিপির কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। আখতার হোসেন বলেন, আমরা চাই, সরকার যৌক্তিক সময়ে গণহত্যার বিচার, সংস্কার ও নির্বাচন দিয়ে বিদায় নেবে। এ ক্ষেত্রে তাদের সদিচ্ছা প্রয়োজন। তিনি বলেন, মানবিক করিডরসহ সব বিষয়ে সব রাজনৈতিক দল ও জনগণের মতামত নিতে হবে। আমরা মনে হয় করিডর নয়, ত্রান আদান-প্রদান করতে পারে। সেটাও আলোচনা করে করতে হবে। সংবাদ সম্মেলনে আরও ছিলেন- এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আব্দুল্লাহসহ কেন্দ্রীয় নেতারা। মানবিক করিডোর প্রসঙ্গে এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, এই বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। আমরা বলছি, মানবিক করিডোরের বিষয়ে যেন কোনো ধোঁয়াশা না থাকে। সরকার আগে দুটি ভিন্ন বক্তব্য দিয়েছে, যা বিভ্রান্তি তৈরি করেছে। পরে পরিস্কার করেছে যে, এটি ত্রাণ আদান-প্রদানের ব্যবস্থা হতে পারে। তবে ত্রাণ কার হাতে থাকবে, কীভাবে পরিচালিত হবে, সেটাও স্পষ্ট করতে হবে। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের কোনো হুমকি যাতে তৈরি না হয়, সেদিকে নজর রাখতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার যেন দায়িত্বশীলভাবে সিদ্ধান্ত নেয়। তিনি বলেন, এই সরকার বিচার, সংস্কার ও ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ নিশ্চিত করে নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হোক-এটাই আমাদের প্রত্যাশা। এই সরকারকে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার প্রয়োজন নেই, তাদের দায়িত্ব হলো কাজ সম্পন্ন করে নির্বাচন আয়োজন করা। সংবাদ সম্মেলনে আরও ছিলেন এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আব্দুল্লাহসহ কেন্দ্রীয় নেতারা।