জাতীয় সংবাদ

ইসরাইলি সেনা প্রত্যাহার শুরু

যুদ্ধবিরতি এবং জিম্মি মুক্তির পরিকল্পনা অনুমোদন
হামাসের সঙ্গে জিম্মি মুক্তির কাঠামোগত চুক্তি
নিজ এলাকায় ফিরছে ফিলিস্তিনিরা

প্রবাহ ডেস্ক : শান্তি চুক্তি অনুযায়ী গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহার শুরু করেছে ইসরাইল। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী শুক্রবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ফিলিস্তিনে যুদ্ধবিরতি স্থানীয় সময় বেলা ১২টা থেকে কার্যকর হয়েছে। উপত্যকার বিভিন্ন স্থানে থাকা সেনাদের সরিয়ে চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত সীমানায় নেওয়া হচ্ছে। বাস্তুচ্যুত হয়ে গাজার দক্ষিণে যাওয়া ফিলিস্তিনিদের উত্তরের দিকে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। খবর আল জাজিরার।
নিউ ইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, সকালে হামাস ও ইসরায়েল যুদ্ধবিরতির চুক্তি অনুমোদনের পর এমন ঘোষণা এলো। তবে তাৎক্ষণিক হুমকি মোকাবিলায় ইসরায়েলি সেনারা প্রস্তুত থাকবে বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর মুখপাত্র আবিচায় আদ্রায়ে বলেছেন, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দক্ষিণ গাজার ফিলিস্তিনিদের প্রধান সড়ক ধরে উত্তরের দিকে চলাচলের অনুমতি দিচ্ছে। তবে গাজার কয়েকটি এলাকায় ইসরায়েলি সেনার সক্রিয় থাকবে। বাসিন্দাদের সেদিকে যেতে দেওয়া হবে না। কারণ এই এলাকাগুলো ‘অত্যন্ত বিপজ্জনক’।
গাজার সিভিল ডিফেন্স এজেন্সির বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, ইসরায়েলি সৈন্য ও সশস্ত্র যানগুলো গাজা সিটি এবং খান ইউনিস থেকে সরে যাচ্ছে। বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিরা এখন নিজ বাড়িতে ফেরার আশায় আছেন।
গাজায় অবস্থানরত এএফপির সাংবাদিকরা হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে গাজা উপকূলের পাশের রাস্তা ধরে হাঁটতে দেখেছেন। খান ইউনিসে আমীর আবু (৩২) নামে এক ব্যক্তি বলেন, শোক নিয়েই আমরা নিজ এলাকার দিকে যাচ্ছি। যদিও সবকিছু এখন ধ্বংসস্তূপ। তবুও সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানাই পরিস্থিতি বদলে যেতে শুরু করেছে।
এর আগে বুধবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানান, তার দেয়া ২০ শান্তি পরিকল্পনার প্রথম পর্যায় বাস্তবায়নে রাজি হয়েছে হামাস ও ইসরাইল। যুদ্ধিবিরতি চুক্তির খবেরে স্বস্তি নেমেছে গাজায়। ইসরাইলে উল্লাস করেছেন জিম্মিদের পরিবারের সদস্যরা।
এদিকে, ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সরকারের নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রিসভা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরিকল্পিত গাজা যুদ্ধবিরতি এবং জিম্মির পরিকল্পনা অনুমোদন দিয়েছে।
এর আগে বৃহস্পতিবার পশ্চিম জেরুজালেমে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ এবং ট্রাম্পের জামাতা এবং সাবেক উপদেষ্টা জ্যারেড কুশনার এর সাথে সাক্ষাৎ করেছেন নেতানিয়াহু। জেরুজালেম থেকে এএফপি এ খবর জানিয়েছে।
যুদ্ধবিরতি চুক্তি এবং জিম্মিও মুক্তির পরিকল্পনার সারাংশ নি¤েœ তুলে ধরা হলো : প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কার্যালয় জানিয়েছে, ইসরাইল গাজা চুক্তির প্রথম পর্যায়ের অনুমোদন দিয়েছে। যার ফলে যুদ্ধবিরতি এবং জিম্মিদের মুক্তি দেওয়া হবে।
ইসরাইলি মন্ত্রিসভা অনুমোদনের পর যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার কথা ছিল, তবে প্রত্যক্ষদর্শীরা এএফপি’কে জানিয়েছেন, রাতভর গাজার কিছু অংশে বিমান হামলা চালানো হয়েছে।
চুক্তির অংশ হিসাবে ইসরাইলের সেনাবাহিনীকে এমন একটি রেখায় প্রত্যাহার করতে হবে যা গাজার প্রায় ৫৩ শতাংশ নিয়ন্ত্রণে রাখবে। হামাসকে ৭২ ঘন্টার মধ্যে ২০ জন জীবিত জিম্মিকে মুক্তি দিতে হবে। আগামী দিনে আরো কী কী ঘটবে তা এখানে দেওয়া হল:
ফিলিস্তিনের একটি সূত্র এএফপি’কে জানিয়েছে, ইসরাইল এরপর ইসরাইলি কারাগারে বন্দী প্রায় ২৫০ জন ফিলিস্তিনি বন্দীকে মুক্তি দেবে এবং গাজা থেকে ১,৭০০ বন্দীকে মুক্তি দিবে।
এদিকে জাতিসংঘ বলেছে, গাজার বাস্তুচ্যুত ২০ লক্ষ মানুষের জন্য শত শত ত্রাণবাহী লরি খাদ্য, ওষুধ এবং জ্বালানি বহন করবে।
এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত – তবে এটি একটি যুদ্ধবিরতি, শান্তি চুক্তি নয়, লিখেছেন লিস ডুসেট। সবচেয়ে কঠিন বিষয়গুলি এখনও টেবিলে রয়েছে। নেতানিয়াহু বলেছেন, ‘আমরা একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতির মধ্যে আছি’। বাস্তুচ্যুত গাজাবাসী এএফপি’কে বলেছেন, বিমান হামলা এখনো ‘অনেক জায়গায়’’ অব্যাহত রয়েছে।
বর্তমানে খান ইউনিসের কাছে আল-মাওয়াসিতে একটি তাঁবুতে বসবাসকারী সুহা শাথ নামের একজন ফার্মাসিস্ট অভিযোগ করছেন, গাজার বেশকিছু জায়গায় এখনো বিমান হামলা অব্যাহত আছে।
তিনি শুক্রকার সকালে বিবিসি রেডিও ৪ এর টুডে প্রোগ্রামের সাথে কথা বলার সময় এই অভিযোগ করেছেন। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পর থেকে গাজার ‘অনেক জায়গায়’ বিমান হামলা অব্যাহত রয়েছে।
তিনি যে পরিস্থিতিতে বাস করেন তা বর্ণনা করে তিনি ব্যাখ্যা করেন যে, তারা মাংস, ডিম বা মাছ ছাড়াই কার্বোহাইড্রেট এবং টিনজাত খাবারের ওপর নির্ভর করে বেঁেচ আছেন। তিনি আরো বলেছেন, যুদ্ধের আগের তুলনায় সবকিছু ‘খুব ব্যয়বহুল’।
তিনি গাজা পুনরুদ্ধারের জন্য সময়ের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে বলেছেন, ‘এই চুক্তির একমাত্র সুবিধা হল হত্যা বন্ধ করা’।
হামাস-পরিচালিত ফিলিস্তিন সিভিল ডিফেন্স গাজাবাসীদের ইসরাইলি সেনাদের অবস্থান এড়িয়ে চলার আহ্বান জানিয়েছে।
টেলিগ্রামে একটি পোস্টে, তাদের মুখপাত্র বলেছেন, ইসরাইল সৈন্য প্রত্যাহারের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত জনগণকে বিশেষ করে গাজা শহরের সীমান্তবর্তী এলাকা এড়িয়ে চলতে হবে। বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে, ‘এই সতর্কতা লঙ্ঘন করলে আপনার জীবন বিপন্ন হতে পারে।’
জেরুজালেমে এএফপি’র সংবাদদাতা জানিয়েছেন, ইসরাইলি মন্ত্রিসভা অনুমোদনের সাথে সাথেই যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা সত্বেও যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে সম্মত হওয়ার পর ইসরাইলি সেনাবাহিনী গাজায় গুলি চালিয়েছে।
সরকারের ভোটের আগে গাজায় ইসরাইলি হামলা অব্যাহত ছিল, কিন্তু আজ সকালে আমরা আরো হামলার একাধিক প্রতিবেদন দেখতে পাচ্ছি।
আমরা উল্লেখ করেছি, প্রত্যক্ষদর্শীরা এএফপি’কে জানিয়েছেন, আজ সকালে খান ইউনিসে বিমান হামলা এবং কামানের গোলাবর্ষণ হয়েছে। আরো উত্তরে নেটজারিম করিডোরের আশেপাশেও গুলিবর্ষণের খবর পাওয়া গেছে। ফিলিস্তিনি সংবাদ সংস্থা ওয়াফার সংবাদদাতারা আজ ভোরে খান ইউনিসে আরো বোমাবর্ষণের খবর পেয়েছেন।
গাজা সিটিতেও আরো হামলার খবর পাওয়া গেছে, যেখানে প্রত্যক্ষদর্শীরা সিএনএন’কে আল-সাব্রা এবং তাল আল-হাওয়া এলাকায় গোলাবর্ষণের কথা জানিয়েছেন।
বিবিসি ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) মন্তব্যের জন্য যোগাযোগ করেছে। তারা জানিয়েছে, তারা প্রতিবেদনগুলো খতিয়ে দেখছে। জনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে আকাশে কালো ধোঁয়া উঠতে দেখা গেছে। শুক্রবার সকালে গাজার আকাশসীমার ওপরে কালো ধোঁয়া উঠতে দেখা গেছে।
অপরদিকে, হামাসের সঙ্গে জিম্মি মুক্তির একটি কাঠামোগত চুক্তি অনুমোদন করেছে ইসরাইল সরকার। এরমধ্য দিয়ে দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা গাজা সংঘাত অবসানে দুই পক্ষই আরো এক ধাপ এগিয়ে গেল। দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর কার্যালয় শুক্রবার এ তথ্য জানিয়েছে। খবর বার্তা সংস্থা এএফপি’র।
ইসরাইল আগেই জানিয়েছিল, ‘সকল পক্ষ’ যুদ্ধবিরতি চুক্তির প্রথম পর্যায়ে স্বাক্ষর করেছে।’ হামাসের হাতে থাকা জিম্মিদের মুক্তি ‘এই যুদ্ধের ইতি টানবে’ বলেও জানায় তারা।
গত মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষিত গাজা বিষয়ক ২০ দফা শান্তি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে মিশরে চুক্তিটি সই হয়। ট্রাম্প রোববার মধ্যপ্রাচ্য সফরে যাবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
চুক্তি সফলভাবে কার্যকর হলে মিশর একটি উদযাপন অনুষ্ঠান আয়োজনের পরিকল্পনা করছে। সেখানে ট্রাম্পেরও উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে। পরবর্তীতে ইসরাইল সফরের পর ধ্বংসস্তূপে পরিণত গাজা সফর করবেন বিবেচনা করছেন।
তেল আবিব জানিয়েছে, বৃহস্পতিবারের বৈঠকের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হবে এবং এই প্রক্রিয়ায় ইসরাইলি সেনারা ধীরে ধীরে গাজা থেকে সরে যাবে। শুক্রবার ভোরে নেতানিয়াহুর কার্যালয় থেকে বিবৃতিতে জানানো হয়, সরকার ‘সকল বন্দির (জীবিত ও মৃত) মুক্তির জন্য চুক্তির কাঠামো অনুমোদন করেছে।’
তবে বিষয়টি নিয়ে নেতানিয়াহু তার কট্টর ডানপন্থী মিত্রদের বিরোধিতার মুখে পড়েছেন। জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন গাভির বলেন, তিনি এই চুক্তির বিপক্ষে ভোট দেবেন। কারণ গাজায় থাকা ৪৭ জন জিম্মির বিনিময়ে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি বন্দির মুক্তিকে ‘অসহনীয় চরম মূল্য’ বলে অভিহিত করেছেন।
চুক্তি নিয়ে ইসরাইল ও গাজায় উচ্ছ্বাসের পাশাপাশি বিশ্ব নেতারাও অভিনন্দন বার্তা পাঠিয়েছেন। কিন্তু এখনো অনেক বিষয় অনির্ধারিত রয়ে গেছে। এরমধ্যে রয়েছে হামাসের অস্ত্র জমা দেওয়ার শর্ত এবং ট্রাম্পের নেতৃত্বে গাজার জন্য একটি অন্তর্র্বতী প্রশাসন গঠনের প্রস্তাব।
হামাসের শীর্ষ নেতা ওসামা হামদান এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। কাতারভিত্তিক আল আরাবি টেলিভিশনকে তিনি বলেন, ‘কোনো ফিলিস্তিনি এটা মেনে নেবে না। সব দল, এমনকি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষও এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে।’
এদিকে ট্রাম্প বলেছেন, হামাসের অস্ত্র জমা দেওয়ার বিষয়টি শান্তি পরিকল্পনার দ্বিতীয় ধাপে আলোচনা করা হবে। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘অবশ্যই নিরস্ত্রীকরণ হবে।’ মার্কিন প্রেসিডেন্ট আরো জানান, ইসরাইলি বাহিনীও ধীরে ধীরে ‘প্রত্যাহার করা হবে’।
মার্কিন কর্মকর্তারা জানান, ইউএস সেন্ট্রাল কমান্ড প্রধান অ্যাডমিরাল ব্র্যাড কুপারের নেতৃত্বে ২০০ সদস্যের একটি সামরিক দল মধ্যপ্রাচ্যে পাঠানো হবে যুদ্ধবিরতি তদারকির জন্য।
একজন কর্মকর্তা জানান, মিশর, কাতার, তুরস্ক এবং সম্ভবত সংযুক্ত আরব আমিরাতের সামরিক কর্মকর্তারা এই দলের সঙ্গে থাকবেন। আরেক কর্মকর্তা বলেন, ‘কোনো মার্কিন সেনা গাজায় প্রবেশ করবে না।’

 

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button