সম্পাদকীয়

পোশাক খাতে শ্রমিক অসন্তোষ নিরসন অতীব জরুরী

অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হলো শিল্প খাত। এ ক্ষেত্রে তৈরি পোশাক শিল্পের অবদান সবচেয়ে বেশি। বিগত কয়েক দশক ধরে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে তৈরি পোশাক শিল্প প্রথম স্থান দখল করে রাখতে সক্ষম হয়েছে। দেশে এখনো তৈরি পোশাক শিল্পের বিকল্প কোনো খাত তৈরি হয়নি। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প যাত্রা শুরু করে ষাটের দশকে। তবে সত্তরের দশকের শেষের দিকে রপ্তানিমুখী খাত হিসেবে এই শিল্পের উন্নয়ন ঘটতে থাকে। বর্তমানে এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানিমুখী শিল্পখাত। ২০২১-২২ অর্থবছরে শুধুমাত্র তৈরি পোশাক শিল্প থেকে রপ্তানির পরিমাণ ৪২.৬১৩ বিলিয়ন ডলার যা বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ৮১.৮১ ভাগ। কিন্তু সস্প্রতি সংকটের মুখে পড়েছে এই পোশাক শিল্প। যার প্রধান কারণ হলো শ্রমিক অসন্তোষ। একসময় বাংলাদেশে পোশাক কারখানার কাজের মান নিয়ে অনেক প্রশ্ন থাকলেও এখন সেখানে কাজের মান, শ্রমিকের নিরাপত্তা, শ্রম আইনে নূন্যতম মজুরির নিশ্চয়তা এবং সেই মজুরি প্রতি পাঁচ বছর অন্তর পুনর্নির্ধারণ করার মাধ্যমে দেশের বৃহত্তম এই রপ্তানি খাতের যথেষ্ট উন্নতি সাধিত হয়েছে। এত কিছুর পরও এই খাত থেকে শ্রমিক অসন্তোষ দূর হয়নি। এক গবেষণায় দেখা যায়, গত তিন দশকে তৈরি পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ২৪ গুণ, অথচ শ্রমিকদের মজুরি বেড়েছে ১৩ গুণ। বর্তমানে তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকেরা যে আন্দোলনে নেমেছেন, তার পেছনে রয়েছে মজুরি-বঞ্চনা। নূন্যতম বেতন বৃদ্ধির দাবিকে কেন্দ্র করে শ্রমিকদের গার্মেন্টস কারখানা ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও হামলায় হুমকির মুখে পড়েছে দেশের তৈরি পোশাক খাত। গত কয়েকদিনে ঢাকা, গাজীপুর, আশুলিয়া ও সাভারে আড়াইশ পোশাক কারখানায় অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও হামলার ঘটনায় অন্তত ৬৫০ কারখানা বন্ধ রাখা হয়েছে। তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকের নূন্যতম মজুরি ৮,০০০ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ১২,৫০০ টাকা করার পরও শ্রমিক পক্ষের কিছু অংশ নূন্যতম মজুরি ২০ হাজার টাকা করার দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে। এতে স্বাভাবিক উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। যা কিনা দেশের সবথেকে বড়ো বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের খাতের জন্য শঙ্কাজনক। তাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এখনি এই শিল্পখাতে রক্ষা করতে পদক্ষেপ নিতে হবে। তৈরি পোশাকশিল্প বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সবচেয়ে বড় খাত। কিন্তু শুধু শ্রমিকদের কম মজুরির ওপর ভিত্তি করে একটি শিল্প খাত টেকসই হতে পারে না। মালিক ও সরকারপক্ষকে এই বাস্তবতা বিবেচনায় নিতে হবে। স্বল্পমেয়াদী ব্যবস্থার পাশাপাশি রপ্তানি পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের বেতন-ভাতার একটি স্থায়ী সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে। এর মধ্যে গার্মেন্টস শিল্প-কারখানা একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে সীমাবদ্ধ না রেখে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে দিতে হবে। বিশেষ করে যে সকল অঞ্চল অনুন্নত এবং যেখানে জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক কম সে সকল অঞ্চলে গার্মেন্টস কারখানা সরিয়ে নিতে হবে। শ্রম উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য দক্ষতা বৃদ্ধি ও কাজের পরিবেশ উন্নয়নের বিকল্প নাই। এজন্য শ্রমিকের বেতন বৃদ্ধি এবং তার নিরাপত্তা ও জীবনের মান উন্নয়নের বিষয়টিও অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে। একজন শ্রমিক যে পরিমাণ উপার্জন করেন, বর্তমান বাজারে তা জীবনধারণের জন্য যথেষ্ট কিনা, তা গার্মেন্টস মালিকদের নজরে রাখতে হবে। চড়াই-উতরাই অতিক্রম করে গত কয়েক দশকের পথ-পরিক্রমায় দেশের তৈরি পোশাকশিল্প আজকের এ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। দেশের অর্থনীতিকে বেগবান করতে পোশাকশিল্পের কোনো বিকল্প নেই। তাই মজুরি নিয়ে তৈরি পোশাক খাতে যে অচলাবস্থা চলছে, অবিলম্বে তার অবসান করতে হবে।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button