মোবাইল আসক্তির বেড়াজালে বন্দি হচ্ছে শিশুরা!

অতিমাত্রায় আসক্তিতে শিশুদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্থ হচ্ছে
মোঃ আশিকুর রহমান ঃ বর্তমান সময়ে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে সর্বক্ষেত্রে। তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে করেছে অতি সহজলভ্য ও আরামদায়ক, জীবনে এনেছে আমুল পরিবর্তন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অন্যতম উপহার হলো স্মার্ট মোবাইল ফোন। বাজারে বিভিন্ন ব্রান্ডের স্মার্ট মোবাইল ফোন আমাদের আধুনিক জীবনের প্রতিটি স্তরকে অতি সহজলভ্যে করে তুলেছে। তবে মোবাইল ব্যবহারে সুফল বয়ে আনলেও সম্প্রতি অতিমাত্রায় মোবাইল আসক্তির বেড়াজালে বন্দি হয়ে পড়েছে শিশুরা। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, কোমলমতি শিশুদের এই মোবাইল আসক্তি একদিকে যেমন মেধা ধ্বংস করছে, তেমনি আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পাচ্ছে কর্মস্পৃহা। মাত্রাতিরিক্ত হারে মোবাইল ফোন ব্যবহারে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে শিশুদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশ। নগরীর বেশ কয়েকটি এলাকার বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিদের সাথে কথা বলা জানা গেছে, এক সময় রূপকথার গল্প শুনিয়ে শিশুদের খাওয়ানো কিংবা ঘুম পাড়ানো আজ বিলুপ্ত। দিন যতই গড়াচ্ছে, ততই শিশুসহ উঠতি বয়সি তরুনেরা ইন্টারনেটের ব্যবহার, হরেক রকম গেইম ও কার্টুনের বেড়াজালের পড়ে মোবাইল ও ইলেকট্রনিক ডিভাইসে অতিমাত্রায় আসক্ত হয়ে পড়ছে। বর্তমান সমাজে দেড় হতে দুই বছরের শিশুরা প্রাথমিক পর্যায়ে অতি সহজে মোবাইল ফোনের ভেতর ইউটিউব বা গুগুলে ঢুকে কার্টুন বা গেইম বের করে অভিভাবকের বাহ্ বাহ্ কুড়াচ্ছে, আর পরবর্তীতে এই বাহ্ বাহ্ পরিনত হচ্ছে চরম আসক্তিতে। ক্রমশঃই ধাপে ধাপে বাড়ছে আসক্তির মাত্রা।
সরেজমিনে, নগরীর স্থানীয় পাড়া-মহল্লার মোড়ে, চায়ের দোকানে, ফাঁকা মাঠে, বিভিন্ন মার্কেট চত্ত্বর, স্কুল-কলেজ ক্যাম্পাস সম্মুখে, যাত্রী ছাউনির নিচে, ক্ষুদ্র বা মাঝারী পরিবহনের ভেতরেসহ বিবিধ স্থানে বসে তরুনেরা গেইম আসক্তির নেশায় মেতে উঠেছে। একই সাথে প্রায় আবাসিক বাসা-বাড়িতেও ছোট্ট ছোট্ট শিশুরা চরমভাবে আসক্ত হচ্ছে কার্টুন বা গেইমে, সেই সাথে পিছিয়ে নেই নারীরাও, মোবাইল অপরেটিং চলছে ফেসবুক বা ইউটিউব জুড়ে। এই আসক্তি তাদের নানামুখি শারিরীক মানসিক বিকাশে বাধাগ্রস্থ করে তুলছে। বলতে গেলে তরুনেরা সম্পূর্নরুপে মোবাইল নামক ইলেকট্রিক ডিভাইসের উপর আসক্ত হয়ে পড়েছে। বর্তমান সময়ে তরুনদের নেই সবুজ মাঠের ঘাসের উপর দৌড়ে গিয়ে কোনো শরীর চর্চা করার সময় বা আগ্রহ। তাই প্রযুক্তিগত সমৃদ্ধি বৃদ্ধি পেলেও হারিয়ে যাচ্ছে ইতিহাস ও ঐতিহ্য, বাড়ছে সামাজিক অবক্ষয়। তথ্য প্রযুক্তির এ যুগে বাস্তবিক জগতের চেয়ে ভার্চুয়াল জগতের (ইন্টারনেটের) প্রতি আসক্তি বাড়ছে শিশুদের। ঘন্টার পর ঘন্টা তারা বুঁদ হয়ে থাকছে অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ও ইলেকট্রনিক ডিভাইসে। বর্তমান এই অবস্থা কেবলমাত্র কেবল ইট পাথরের এই শহরের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, শহর ছাড়িয়ে এখন গ্রামন্তরেও।
অভিভাবক সুমাইয়া সাদিয়া জানান, আমার বাচ্চার সকালটা শুরু হয় মোবাইল দিয়ে। এটা কোনো ভাবেই কন্ট্রোল করতে পারছি না। মোবাইল না দিলে কিছু খেতে চায় না, কান্নাকাটি করে। তখন বাধ্য হয়ে ফোন দিতে হয়। কি করবো? ক্রমশঃই মোবাইলের প্রতি বাচ্চার আসক্তি বাড়ছে। ফোন হাতে দিলে খায়, না দিলে ঝামেলা করে। জানি এটা বাচ্চাদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর তবুও করার কিছু নেই। স্কুল ছাত্র তন্ময় জানায়, কোচিং, ব্যাচ আর বাসার টিচারের পড়াশুনার চাপে বন্ধুদের সাথে বিকালে মাঠে গিয়ে খেলার সময় হাতে থাকে না। সকালে স্কুল, স্কুল হতে ফিরতে না ফেরতে বিকালে কোচিং আবার সন্ধ্যার পর বাসার টিচার, সময় কোথায়? তাই যখনি একটু সময় পাই মোবাইলে গেইম খেলি বা মুভি দেখি। সাবেক কাউন্সিলর এসএম হুমায়ূন কবির জানান, মোবাইল আমাদের জীবনকে অতি আরাম দায়ক করে তুলেছে, বিশেষ করে যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে। তাছাড়া সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম এই ক্ষুদ্র ডিভাইসটির ভুমিকা অনস্বীকার্য। তবে বর্তমান সময়টিতে শিশুসহ তরুনেরা যেভাবে মোবাইল ডিভাইসে আসক্ত হচ্ছে তা অনেকটাই সামাজিক বন্ধন ছিন্ন করে তুলছে। গেইমের নেশা তরুণদের বিভীষিকাময় করে তুলছে। এই আসক্তি হতে বেরিয়ে আসা উচিৎ বলে আমি মনে করি, নইলে আগামী প্রজন্ম ধ্বংসের দিকে ধাপিত হবে। শিশুদের মোবাইল ফোন আসক্তির বিষয়ে নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞদের তথ্যমতে, এটি তাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। মোবাইল ফোন থেকে নির্গত রশ্মি শিশুদের দৃষ্টিশক্তির ভীষণ ক্ষতি করে। যেসব শিশুরা দৈনিক পাঁচ-ছয় ঘণ্টা মোবাইল ফোন অপারেট করে থাকে, খুব অল্পবয়সে তাদের চোখের সমস্যা হবে। সেদিন খুব বেশি দূরে নয়, যখন মোবাইল ফোনকে সিগারেটের চেয়েও বেশি ক্ষতিকর হিসেবে চিহ্নিত করা হবে।



