স্থানীয় সংবাদ

বাগেরহাটে শিশু শিক্ষার প্রকল্পে একটি বেসরকারী সংস্থার ১২ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ

আজাদুল হক, বাগেরহাট প্রতিনিধি ঃ শিশু শিক্ষার প্রসারে প্রধানমন্ত্রী একান্ত সদিচ্ছায় দেয়া প্রকল্পের বাগেরহাট জেলার প্রায় ১২ কোটি টাকা আত্মসাত হয়েছে। দলীয় বিবেচনায় বেসরকারী একটি সংস্থা এ প্রকল্প নিয়ে বাগেরহাটে সম্পুর্ন ব্যর্থ হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। পারিবারিক নানা প্রতিকূলতার কারণে যে সব শিশু শৈশবেই স্কুল পরিত্যাগ করেছে , লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে, তাদের লেখাপড়া শেখানোর জন্য এ প্রকল্প চালু হয়। বাগেরহাটের প্রেক্ষাপটে তা বাস্তবায়নে সুখী মানুষ নামের একটি বেসরকারী সংস্থা এ কাজ নেয়। অথচ, সুখী মানুষ এনজিওর বিরুদ্ধে বিগত সময়ে ব্যাংক জালিয়াতি, পার্টনার বা সহযোগি এনজিওদের পাওনা অর্থ বুঝিয়ে না দেওয়া, স্কুল শিক্ষক, উপজেলা ম্যানেজার, সুপারভাইজার নিয়োগে নগদ অর্থ গ্রহন, বিধিবহির্ভূত ভাবে ব্যাংক থেকে ক্যাশ টাকা তুলে আত্মসাত করা, বেতন না দিয়ে হুমকি ধামকি প্রদান, শিশু শিক্ষার্থীদের স্কুল ড্রেস, বই, খাতা, পেন্সিল, শ্লেটসহ বিভিন্ন প্রকার শিক্ষা উপকরন যথাযথভাবে প্রদান না করে সেই টাকা তুলে আত্মসাত করা, শিখন কেন্দ্রের ভাড়া বকেয়া রেখে শিক্ষকদের হয়রানি করার সুনির্দ্দিষ্ট অভিযোগ ওঠে । এ বিষয়ে ওই সংস্থার নিয়োগকৃত শিক্ষিকা সুমি আক্তার ও পলি আক্তার সহ একাধিক শিক্ষীকা জানান, প্রকল্পের শুরু থেকে জরিপ থেকে শুরু করে ১২ মাস ক্লাস করানোর পর আমাদের কোন বেতন ভাতা ,শিখন কেন্দ্র ভাড়া না দিয়েই আমাদের চাকুরীচ্যুত করেছে সুখী মানুষ এনজিও । তারা তাদের বেতন ভাতা জরিপের টাকা প্রদানের জন্য উদ্ধতন কর্মকর্তাদের দৃষ্টি আকর্ষন করেছেন। বাগেরহাটের জেলার চিতলমারী উপজেলার কাঠিপাড়া গ্রামের একটি শিখন কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেছে একই ঘরের মধ্যে তিনটি ভাগ করে এক পাশে হাঁস পালন, এক পাশে শিশুরা পড়ছে মাঝখানে মুরগী আর ঘরের মাচায় কবুতরের বসবাস । এ বিষয় জানতে চাইলেন ক্ষেপে যান শিখন কেন্দ্রের শিক্ষিকা দিপালী । ঘর ভাড়া নিয়ে আলাদা ক্লাস করানোর কথা থাকলেও দেখা যায় ঘরের বারান্দা ভাড়া নিয়ে ক্লাস করাচ্ছেন এনজিও সুখী মানুষ । গত বুধবার বাগেরহাট সদরের ষাটগম্ভুজ ইউনিয়নের বোয়ালমারী শিখন কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায় মাদ্রাসায় ৬ষ্ট শ্রেনিতে পড়ে আর এখানে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ছে একজ শিক্ষার্থী । এ কেন্দের একজন অভিভাবক বলেন সুখী মানুষ নিয়মিত স্কুলভাড়া দেয়না চাকুরী টিকিয়ে রাখার জন্য শিক্ষক লোন তুলে মালিককে ভাড়ার টাকা পরিশোধ করেছে। এ অবস্থা জেলার প্রায় সব কেন্দ্রেই বলে প্রচার পেয়েছে। এ বিষয়ে গত ৪ ফেব্রুয়ারি বাগেরহাট জেলা উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর সহকারি পরিচালক, মহাপরিচালক বরাবরে একটি চিঠি দিয়েছেন । ওই চিঠিতে তিনি, কিভাবে বাগেরহাটে এই শিশু শিক্ষা প্রকল্পটি কার্যকর হয়নি এবং লীড এনজিও “সুখী মানুষ” কি ভাবে চরম অসহযোগিতা করেছে সেই অনিয়মের বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন। “সুখী মানুষ” এনজিওটির এই প্রকল্পে কাজ করার কেনো সক্ষমতা নেই বলেও তিনি ওই চিঠিতে মন্তব্য করেছেন । এ প্রকল্পের কাজ বিষয়ে এক অনুসন্ধানে যানা গেছে, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো কর্তৃক পরিচালিত “আউট অব স্কুল চিলড্রেন এডুকেশন প্রকল্প” বাগেরহাট জেলায় বাস্তবায়নের জন্য “সুখী মানুষ” এনজিওকে লীড এনজিও হিসেবে মনোনীত করে। সেই সময় এনজিওটি বড় ধরনের ব্যাংক জালিয়াতি করেছিল । প্রকল্পটির বাগেরহাট জেলার সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য সরকার থেকে ৩৫ কোটি ৩১ লক্ষ ৫৩ হাজার টাকা বরাদ্দের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়। যার মধ্য থেকে ইতোমধ্যে প্রায় ১২ কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে । একাধিক সুত্র থেকে জানাগেছে , লীড এনজিওর সঙ্গে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর চুক্তির ৪৮.১ অনুচ্ছেদে এনজিওর আর্থিক সক্ষমতা হিসেবে ২৫ লাখ টাকা ব্যাংক স্থিতি রেখে ব্যাংক সলভেন্সি সার্টিফিকেট দাখিল করা বাধ্যতামূলক ছিল। “সুখী মানুষ” যে ব্যাংক সলভেন্সি সার্টিফিকেট দাখিল করেছিল তা একটি বড় ধরনের ব্যাংক জালিয়াতি। সুখী মানুষ এনজিও যে ব্যাংক একাউন্ট প্রদান করে তা হলো : হিসাব নাম- সুখী মানুষ , হিসাব ন¤॥^র এ/সি নং ০১২১১১১০০০০৬০৩,ব্যাংকের নাম : মার্কেল টাইল ব্যাংক লিমিটেড, খুলনা. ব্রাঞ্চ ও ঠিকানা: খুলনা ব্রাঞ্চ, খুলনা. কিন্তু এই নামে এবং এই হিসাব নম্বরে উক্ত ব্যাংকে “সুখী মানুষ” এনজিও’র কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্টের অস্তিত্ব নেই বলে জানা গেছে । বাগেরহাট জেলা উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর তৎকালীন সহকারি পরিচালক গত ২০২১ সালের ২৯ ডিসেম্বর সুখী মানুষ এনজিওর ব্যাংক একাউন্ট যাচাই করার জন্য মার্কেন্টাইল ব্যাংক, খুলনা শাখায় একটি চিঠি (নথি নং-৩৮.০২.০১০০.০০০.১৪.০২৫.২১-৩১৭) প্রদান করেন। এই একাউন্টটি যাচাই করে মার্কেন্টাইল ব্যাংক খুলনা শাখার হেড অব ব্রাঞ্চ, ভাইস প্রেসিডেন্ট এমডি. আব্দুল মতিন প্রত্যয়ন করেন যে, সুখী মানুষ এনজিওর নামে উক্ত নম্বরের কোন হিসাব নেই। বিষয়টি লিখিতভাবে তৎকালীন সহকারী পরিচালক উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোকে অবহিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের অনুরোধ করেছিলেন। আইন এবং বিধি অনুযায়ি এই বড় জালিয়াতি করার পর লীড এনজিও হিসেবে সুখী মানুষের প্রকল্পের কাজ পাওয়ার কথা নয়। প্রশ্ন উঠেছে, সুখী মানুষ এতো বড় আর্থিক জালিয়াতি/ব্যাংক জালিয়াতি করেও কিভাবে কাজ পেলো, কারা তাকে কাজ পেতে সহায়তা করেছে এবং সুখী মানুষ সংস্থাটি শুরু থেকে এখনও পর্যন্ত যে আর্থিক দুর্নীতি করে যাচ্ছে তা কাদের সহযোগিতায় করছে তা উদঘাটন করা প্রয়োজন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়াও, প্রকল্প শুরুর প্রথম থেকে প্রতিষ্ঠানটি নিজ দায়িত্বে থাকা বগেরহাট সদর, চিতলমারী, ফকিরহাট, এবং মোল্লাহাট উপজেলায় প্রকল্পে নির্দেশিত গাইডলাইন অনুসারে সঠিক জরিপ না করে, মান সম্পন্ন কেন্দ্র, শিক্ষা উপকরন ব্যতীত মৌখিকভাবে কেন্দ্র চালু দেখিয়ে বর্তমান সময় পর্যন্ত ওই প্রতিষ্ঠানটি বিপুল অঙ্কের টাকা আত্মসাত করেছে। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত “সুখী মানুষ” এনজিওর দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে, নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র বলেছেন, বরাদ্দকৃত টাকার অধিকাংশ “সুখী মানুষ” সংস্থা সঠিকভাবে প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় না করে তার ব্যক্তিগত বিভিন্ন দায়-দেনা পরিশোধ করেছেন। যে কারণে তার প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্বে থাকা ৪টি থানায় নগর এবং গ্রামের অনগ্রসর বা ঝড়ে পড়া শিশুদের লেখাপড়া শেখানোর অভিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে মহৎ উদ্দেশ্যে প্রকল্পটি চালু করেছিলেন তা বাগেরহাট জেলায় সম্পূর্নরূপে ব্যর্থ হয় বলে অভিযোগ। এ ছাড়াও ‘সুখী মানুষ’ প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে দুদক, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোতে বাগেরহাট জেলায় প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা একাধিক সহকারী পরিচালকবৃন্দ অভিযোগ দায়ের করেছিলেন। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী রুমানা আলী সাংবাদিকদের বলেছেন, শিক্ষাখাতে যে সব দুর্নীতির কথা তিনি জানতে পেরেছেন তার মূল উৎপাটন করবেন। দেশের অন্যতম আইন গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ল’ অ্যান্ড পলিসি এ্যাফেয়ার্স পরিচালক অ্যাডভোকেট সৈয়দ মাহবুবুল আলম বলেছেন, শিক্ষা নিয়ে জালিয়াতি কোনো ভাবেই টলারেট না। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, শিশুদের শিক্ষা নিয়ে দুর্নীতি করলে, ভবিষ্যতে শিক্ষিত জাতি গড়ে উঠবে কি ভাবে ? সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এটা কঠোরভাবেই দেখা উচিৎ। যে সব এনজিও শিশু শিক্ষার ক্ষেত্রে এমন দুর্নীতি করে তাদের কেন নবায়ন দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা শিক্ষা অধিদফতর। কারা সহায়তা করে কিংবা কিভাবে এনজিওগুলো দুর্নীতি করার সুযোগ পায় সেই বিষয়টিও সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের খতিয়ে দেখা উচিৎ। অভিযোগ বিষয়ে কথা বলার জন্য সুখী মানুষ এনজিওর নির্বাহী পরিচালক নাফিজা আফরোজ বর্ণ এর ০১৭১২৫৫৫৭৮৮ নম্বর মোবাইলে ফোন দিলেও তিনি ফোন ধরেনি। এ বিষয়ে বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মোহা. খালিদ হোসেন সংবাদ কর্মীদের বলেন, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো কর্তৃক পরিচালিত “আউট অব স্কুল চিলড্রেন এডুকেশন প্রকল্প” “সুখী মানুষ”এনজিও বাগেরহাট জেলায় বাস্তবায়ন করছে। এদের বিরুদ্বে কিছু অভিযোগ আমার কাছে এসেছে যেমন, শিখন কেন্দ্রে ছাত্র ছাত্রীর সংখ্যা কম, যে সকল ছাত্র ছাত্রী এখানে দেখানো হয়েছে তারা প্রকৃত এখানের ছাত্র ছাত্রী না। এছাড়া আরো কয়েকটি বিষয় আছে । আমি ইতিমধ্যে এবিষয়টি নিয়ে এখানকার সহকারী পরিচালকের সাথে কথা বলেছি । আমি আরো ভালো ভাবে খোজ খবর নিয়ে এধরনের কোন ব্যাপ্তায় থাকে আইনের আমি সে বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহন করব ।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button