
পরিবারে ঋণ আতঙ্ক
এম আব্দুর রহমান বাবু, শ্যামনগর থেকে ঃ বাচ্ছু মৌয়ালের বাড়িতে চলছে স্বজন হারানোর বিলাপ, পরিবারে ঋণ আতঙ্ক। লাশের চেয়ে ভারী হয়ে উঠেছে ঋণের বোঝা।দিশেহারা তার পরিবারের লোকজন। সুন্দরবনে বাঘের আক্রমণে নিহত মৌয়াল মনিরুজ্জামান বাচ্ছু গাজীর শোকস্তব্ধ স্বজনরা। পাশাপাশি দুটি ঘর। ছাউনি অ্যাসবেস্টসের। ঘর দুটির বারান্দায় প্রতিবেশী-স্বজন। একটি ঘরের ভেতর থেকে কিশোরীকণ্ঠের কান্না ভেসে আসছে। মরাকান্না যাকে বলে। এ ছাড়া পুরো বাড়িই একরকম সুনসান, শোকস্তব্ধ। দু’দিন আগে এই বাড়ির একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি মনিরুজ্জামান গাজী বাচ্চু (৪২) সুন্দরবনে মারা গেছেন, বাঘের আক্রমণে। উত্তর প্রান্তের ঘরটির বারান্দায় মাথায় হাত দিয়ে বসেছিলেন বাচ্চুর প্রথম স্ত্রী রহিমা খাতুন। তাঁর পাশেই বসেছিলেন জবেদা খাতুন। সত্তরোর্ধ্ব এই নারী মাস দুয়েক আগে হারিয়েছেন স্বামী। এবার তাঁর বড় ছেলের প্রাণ কাড়ল বাঘ। তাই যেন শূন্য দৃষ্টি। মুখের ভাষা যেন লোপ পেয়েছে। গত সোমবার এই চিত্র দেখা যায় বাচ্চু গাজীর বাড়িতে। তিনি সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের ডুমুরিয়া গ্রামের মৃত আবুল কাশেমের ছেলে। দুই সংসারে দুই ছেলে, দুই মেয়ে। সব মিলিয়ে ১০ জনের দায়িত্ব ছিল বাচ্চুর কাঁধে। সরজমিনে তাঁর বাড়ির সন্ধানে সেদিন সকালে ডুমুরিয়া খেয়াঘাট থেকে পশ্চিম দিকে হেঁটে রওনা দিলেন প্রতিবেদক । উপকূল রক্ষা বাঁধ ধরে ১৮-২০ মিনিট এগুলে বাম পাশে পড়ে সরু একটি গ্রামীণ সড়ক। স্থানীয় লোকজনের তথ্যে আঁকাবাঁকা সেই পথ ধরে আর কিছুদূর এগিয়ে যেতেই বাচ্চুর বাড়ি। শুয়ে বিলাপ করছিলেন বাচ্চুর দ্বিতীয় স্ত্রী খাদিজা বেগম। তিনি বুকে জড়িয়ে রাখছিলেন ৯ বছর বয়সী ছেলে বাদশাকে। কান্নার তোড় সামলে সামলে বলছিলেন, ‘আল্লাহ! আমার ছেলের সব দিতি পারবানে। কিন্তু বাপ দেবো কন তে (কোথা থেকে)।’ বারবার বাবার সন্ধান চাইছিল বাদশা। তাই মা খাদিজা এমন প্রলাপ করছিলেন বলে জানান এক প্রতিবেশী। পাশের ঘর থেকে থেমে থেমে কান্নার শব্দ ভেসে আসছিল। ওই ঘরে ডুকরে কাঁদছিল বাচ্চুর দুই মেয়ে শারমিন খাতুন টুম্পা (১৩) ও খাদিজা আক্তার (১৫)। সেখানে ছিলেন মধু সংগ্রহে যাওয়া বাচ্চুদের দলের সাজনী (পথপ্রদর্শক) ভাগনে সাইফুল ইসলাম। তাঁর ঢিল ছোড়া দূরত্ব থেকে বাঘে মামাকে টেনে নিয়ে যায় বলে জানান। সাইফুল বলেন, এই স্মৃতি আজীবন তাড়িয়ে বেড়াবে তাঁকে। সংবাদকর্মী পরিচয় পেয়ে মৌয়ালদের লোকাচার ও আজন্ম লালিত বিশ্বাসের বর্ণনা দেন বাচ্চুর ছোট ভাইয়ের স্ত্রী হাফিজা বেগম। তাঁর ভাষ্য, মৌয়ালরা শুক্রবার কখনও বনে মধু সংগ্রহে যান না। দিন গণনার ভুলে ‘শুক্রবার মালে (বনে) উঠাই কাল হয়েছে’ বলে মন্তব্য করেন তিনি। সেই মূল্য তাঁর ভাসুরকে চুকাতে হয়েছে জীবন দিয়ে!
মামার মৃত্যুর ঘটনায় বিশ্বাসভঙ্গের দিকে আঙুল তোলেন সাইফুলও। তিনি বলেন, টানা ১৬-১৭ দিন বনে থাকায় তারা দিন গণনায় ভুল করেছিলেন। বৃহস্পতিবারকে শুক্রবার ধরেছিলেন। আর শনিবার ভেবে শুক্রবারেই বনে যান। চাক কাটার জন্য কাড়ু তৈরি করছিলেন। তাঁর মাত্র চার-পাঁচ ফুট দূরত্বে থাকা মামা বাচ্চুকে বাঘে ধরে নিয়ে যায়। রেওয়াজ মেনে ও অন্যদের সতর্ক করতে মামার রক্তমাখা জামা ঘটনাস্থলে একটি গাছের ডালে ঝুলিয়ে এসেছেন। বাচ্চু গাজী ছিলেন পুরোদস্তুর বনজীবী। সুন্দরবন থেকে মাছ ও কাঁকড়া শিকার করতেন। পাশাপাশি বন-বাদা বন্ধের সময়ে নদী থেকে ধরতেন মাছের রেণু। মৌসুমে সহযোগীদের নিয়ে বনে যেতেন মধু সংগ্রহের জন্য। এভাবেই ১০ জনের সংসার চালাতেন। সহযোগী মৌয়াল আমিনুর গাজী বলেন, তাদের দলে ছয়জন ছিল। ২ এপ্রিল বুড়িগোয়ালিনী স্টেশন থেকে মধু সংগ্রহের অনুমতিপত্র নিয়ে বনে যান। শুক্রবার দুপুরের পর দারগাং এলাকার নোটাবেঁকীতে ছাটা দেওয়ার সময় বাচ্চুকে টেনে নিয়ে যায় বাঘে। চিৎকার ও ধস্তাধস্তির শব্দে অন্য পাঁচজন এগিয়ে গেলেও তাঁর খোঁজ পাননি। পরে আশপাশের মৌয়াল দলের সদস্য ও বন বিভাগ কর্মীদের নিয়ে গভীর বন থেকে মরদেহ উদ্ধার করেন। বাঘ বাচ্চুর ডান হাত ও ডান পায়ের কিছু অংশ খেয়ে ফেলে। শনিবার দুপুরে লাশ বাড়িতে আনার পর জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে বাবার পাশে তাঁকে দাফন করা হয়। বাচ্চুর বড় ছেলে সুমন হোসেন তাজলীমুখা দাখিল মাদ্রাসার ছাত্র। সে জানায়, বাবা বনে যাওয়ার সময় সে নানাবাড়িতে ছিল। তাঁর সঙ্গে দেখা না হওয়ায় বাবা অনেক কেঁদেছিলেন বলেও জানায় সে। সুমনের মা রহিমার ভাষ্য, নওয়াবেঁকী গণমুখী ফাউন্ডেশন থেকে ৪৯ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন তাঁর স্বামী। আর মধু সংগ্রহে যাওয়ার আগে মহাজনের কাছ থেকে দাদন নেন আরও ৬০ হাজার টাকা। তিনিই ছিলেন একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তাঁর মৃত্যুতে ঋণ কীভাবে শোধ করবেন, এই চিন্তায় তারা দিশাহারা। তারা দুই সতিন, চার সন্তান ও বৃদ্ধা শাশুড়ির ভবিষ্যৎ নিয়েও দুর্ভাবনায় পড়েছেন। ইতিমধ্যে শ্যামনগর উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে তাদের পরিবারকে বেশ কিছু আর্থিকভাবে সাহায্য করা হয়েছে বলে জানান শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার। গাবুরা ইউপি চেয়ারম্যান মাসুদুল আলম জানান, বাচ্চু গাজী খুব সহজ-সরল ছিলেন। এলাকাবাসীর কাছে খুব প্রিয় ছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে পরিবারটি হতাশার সাগরে ডুবতে বসেছে। এই মৌয়াল বৈধভাবে বনে গিয়েই বাঘের হামলায় পড়েন বলে জানান পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক এ কে এম ইকবাল হোসাইন চৌধুরী। তিনি বলেন, ঘটনাস্থল যদি বাংলাদেশের বনাঞ্চল হয়, তবে পরিবার বন বিভাগের ব্যবস্থাপনায় আর্থিক সুবিধা পাবে। তাঁর দেওয়া তথ্যমতে, গত পাঁচ বছরে বৈধভাবে সুন্দরবনে গিয়ে বাঘের আক্রমণে পাঁচজনের প্রাণ গেছে। তাদের পরিবার আর্থিক অনুদান পেয়েছে। বাঘের আক্রমণে আহত এক ব্যক্তিও আর্থিক সুবিধার জন্য তাদের কাছে আবেদন করেছিলেন। বাঘের আক্রমণ থেকে সুরক্ষার জন্য বন বিভাগ থেকে কিছু পরামর্শ দেওয়া হয় বলেও জানান এ কে এম ইকবাল হোসাইন চৌধুরী। তিনি বলেন, সুন্দরবনে সাধারণত মৌয়ালরা দলবেঁধে যান। তাদের অনুমতি দেওয়ার সময় এক-দুই জনকে পাহারায় থাকতে বলা হয়। এ ছাড়া বাঘ সদ্য হেঁটে গেছে, তাদের নতুন পায়ের ছাপ দেখলে– ওই এলাকা এড়িয়ে চলারও পরামর্শ দিয়ে থাকেন।