স্থানীয় সংবাদ

দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড যশোরে ৪৩.৮ ডিগ্রি

হিট স্ট্রোকে খুলনাসহ ১০ জেলায় এক সপ্তাহে মৃত্যু ১০ জন : স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

তিব্র তাপদাহে উত্তপ্ত খুলনা বিভাগ : বৈদ্যুৎতিক পাখা চালিয়েও শরীর ঠান্ডা হচ্ছে না
সাতক্ষীরায় হিট স্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু

কামরুল হোসেন মনি ঃ অতি তিব্র তাপদাহে উত্তপ্ত খুলনা বিভাগ জুড়ে। কখনও তীব্র আবার কখনও খুব তীব্র আকার ধারণ করছে খুলনা বিভাগে তাপপ্রবাহ। দেশে ইতিহাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড যশোরে ৪৩ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গতকাল মঙ্গলবার এমন তাপদাহ গত ৫২ বছরের মধ্যে রেকর্ড। খুলনা বিভাগ জুড়ে তাপমাত্রা ছিলো ৪১ থেকে ৪৩ ডিগ্রি ওপরে। এই দিনে খুলনায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪১ দশমিক ৫ ডিগ্রি ও চুয়াডাঙ্গায় ৪৩ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এমন তাপদাহে বৈদ্যুৎতিক পাখা চালিয়ে মানুষের শরীরে ঠান্ডা মিটছে না। এর মধ্যে থেকেও ঝরছে ঘাম। মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা ক্লাস করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। সরকারি হিসাব অনুযায়ী গত এক সপ্তাহে সারা দেশে হিটস্ট্রোকে খুলনাসহ ১০ জেলাতে মৃত্যু হয়েছে ১০ জনের বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছেন।
খুলনা আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ সিনিয়র আবহাওয়াবিদ মো:. আমিরুল আজাদ বলেন, গতকাল মঙ্গলবার দুপুর তিনটার পর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বিরাজ করছে যশোরে ৪৩ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা চলতি মৌসুমে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। আর চুয়াডাঙ্গায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪৩ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ ছাড়া খুলনায় ৪১ দশমিক ৫ ডিগ্রি, খুলনার কয়রায় ৪২ দশমিক ৩ ডিগ্রি, মোংলায় ৪২ ডিগ্রি, ইশ^রদীতে ৪৩ দশমিক ২ ডিগ্রি এবং সাতক্ষীরায় ৪২ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। এ ছাড়া রাজশাহীতে ৪৩ ডিগ্রি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। এর আগের দিন সোমবারে গত ২৫ বছরের মধ্যে খুলনায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিলো ৪১ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এছাড়া ওই দিন খুলনা বিভাগের মধ্যে চুয়াডাঙ্গায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। এই দিনে চলতি মৌসুমে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিলো। আর যশোরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিলো ৪২ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এছাড়া ওই দিনে কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে ৪১ দশমিক ৫ ডিগ্রি, সাতক্ষীরায় ৪১ দশমিক ৫ ডিগ্রি, মোংলায় ৪১ দশমিক ১ ডিগ্রি এবং কয়রায় ৪১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। আর পাবনার ঈশ্বরদীতে ৪২ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবহাওয়ার এমন উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে সারা দেশে সরকারি হিসাব অনুযায়ী খুলনাসহ ১০ জেলাতে গত এক সপ্তাহে হিট স্ট্রোকে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। মঙ্গলবার সকাল ৯টা পর্যন্ত এদের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া পাঁচজন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। সারা দেশে হিট স্ট্রোকে মারা যাওয়া এ ১০ জনের মধ্যে ৮ জন পুরুষ, ২ জন নারী। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম সূত্র মঙ্গলবার সকালে এ তথ্য জানিয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম ২২ এপ্রিল থেকে সারা দেশের সরকারি হাসপাতালে হিট স্ট্রোক রোগীর তথ্য সংগ্রহ শুরু করেছে। প্রতিষ্ঠানটি গতকাল মঙ্গলবার জানিয়েছে, হিট স্ট্রোকে নতুন করে মারা যাওয়া তিনজনের মধ্যে দু’জনের মৃত্যু হয়েছে মাদারীপুর জেলায়। আরেকজনের মৃত্যু হয়েছে চট্টগ্রাম জেলায়। এছাড়া চুয়াডাঙ্গা, খুলনা, হবিগঞ্জ, রাজবাড়ী, ঝিনাইদহ, লালমনিরহাট, বান্দরবান ও চট্টগ্রাম জেলায় একজন করে মারা গেছেন। প্রতিষ্ঠানটির সংগৃহীত তথ্যে সর্বশেষ সোমবার হিট স্ট্রোকে তিনজন মারা যান। এছাড়া হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে আরও পাঁচজন দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, উষ্ণতাজনিত অসুস্থতার চিকিৎসায় একটি গাইডলাইন তৈরি করা হয়েছে। ২২ এপ্রিল এই নির্দেশিকা ব্যবহারে প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। এই গাইডলাইন ‘অন ম্যানেজমেন্ট অব হিট রিলেটেড ইলনেস’ এর ভিত্তিতে সারা দেশের চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে অনলাইনে। অপরদিকে খুলনা বিভাগে অতি তাপপ্রবাহে এতে সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। ভ্যাপসা গরমে নাভিশ্বাস উঠেছে জনজীবনে। দিন এবং রাতের তাপমাত্রায় খুব বেশি পার্থক্য নেই। দিনের আলো ফোটার পর থেকেই উত্তপ্ত হতে থাকে পরিবেশ। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও প্রকট হচ্ছে রোদের উত্তাপ। আবার সন্ধ্যার পর ভ্যাপসা গরমে পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলছে। তীব্র হচ্ছে গরমের অনুভূতি। বৃষ্টির পানির জন্য হাহাকার করছে মানুষ। সকাল সকাল শ্রমজীবী মানুষেরা কাজের সন্ধানে বেরিয়েও ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন। টানা তাপদাহে খুলনার মানুষ ও প্রাণিকুল ওষ্ঠাগত। নাকাল এ অঞ্চলের জনজীবন। নগরীর বড় বাজার এলাকায় পান দোকানী মো: আবুল হোসেন বলেন, দোকেন মধ্যে ফ্যান (বৈদ্যুৎতিক) চলছে, তারপরেও শরীরের থেকে টপ টপ করে ঘাম ঝড়ছে। রোদের দিকে তাকালে মনে হচ্ছে চোখ ঝলসে যাচ্ছে। রাস্তা থেকে যেন আগুনের আঁচ উঠছে। শরীরের চামড়ায় ফোসকা পড়ে যাচ্ছে। কিন্তু ঘরেও তো বসে থাকা যাচ্ছে না। কাজের জন্য সড়কের পাশে বসতেই হচ্ছে। ইজিবাইক চালক মো: কালাম বলেন, গত কয়েকদিন ধরে অতি প্রয়োজন না হলে মানুষজন তীব্র গরমে ঘর থেকে বেরই হচ্ছে না। যারা বের হচ্ছেন তাও সন্ধ্যার পর। দিনে রোদের তাপ আর রাতে ভ্যাপসা গরমে কাজকর্ম করা যাচ্ছে না। কঠিন হয়ে পড়ছে সবকিছু।
সাতক্ষীরায় হিট স্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু :
আমাদের সাতক্ষীরা প্রতিনিধি জানিয়েছেন, প্রচন্ড তাপদাহে সাতক্ষীরায় হিট স্ট্রোকে মোঃ ফারুক হোসেন নামে বেসরকারি স্কুলের এক শিক্ষকের মৃত্যু হয়েছে। মঙ্গলবার সকালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। এর আগে সোমবার তিনি তার কর্মস্থল শহরের নবারুণ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে প্রথমে তাকে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে তার অবস্থান অবনতি হলে রাতে খুলনা সিটি মেডিকেলে ভর্তি করা হয়। মৃত শিক্ষক ফারুক হোসেন ওই বিদ্যালয়ের সহকারি ইংরেজী শিক্ষক। নবারুণ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক নাজমুন লায়লা জানান, গত সোমবার সকালে ফারুক হোসেন বিদ্যালয়ে আসার পর হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। এসময় দ্রুত তাকে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানকার মেডিসিন বিভাগের প্রধান ডা: কাজী আরিফ তাকে দেখার পর অতিরিক্ত গরমের কারনে হিট স্ট্রোক হয়েছে বলে ধারণা করেন। পরে সেখানে তার অবস্থার অবনতি হলে তাৎক্ষনিক ভাবে তাকে খুলনা সিটি মেডিকেলে ভর্তি করা হয়। সেখানে লাইফ সাপোর্টে থাকাকালীন অবস্থায় আজ সকালে তার মৃত্যু হয়। সাতক্ষীরা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জুলফিকার আলী রিপন জানান, মঙ্গলবার বিকাল ৩ টায় সাতক্ষীরার তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪২.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এসময় বাতাসের আদ্রতা ছিল শতকরা ২৫ ভাগ। তিনি আরো বলেন, ২১ বছরের মধ্যে এটি জেলার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা।
৩ দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা :
গত ২৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা দেখলো দেশবাসী, যা ১৯৭২ সালের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। আবহাওয়াবিদ মো. শাহীনুল ইসলাম জানিয়েছেন, গতকাল মঙ্গলবার যশোরে ৪৩ দশমিক ৮ ডিগ্রি এবং চুয়াডাঙ্গায় ৪৩ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। এরআগে, ১৯৯৫ সালে চুয়াডাঙ্গায় ৪৩ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছিল। আর দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১৯৭২ সালের ১৮ মে, ৪৫ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গতকাল মঙ্গলবার ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৩৮ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঢাকায় ১৯৬৫ সালে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ওঠেছিল ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। এর আগে ১৯৬০ সালে ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা হয়েছিল ৪২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এদিকে গতকাল মঙ্গলবার বিকেল ৩টার দিকে এ জেলার তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪৩ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা চলতি বছর এখন পর্যন্ত এটিই দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা জানিয়েছে চুয়াডাঙ্গা আঞ্চলিক আবহাওয়া অফিস। এর আগে ১৯৮৫ সালে ৪৩ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছিল। এরপর চুয়াডাঙ্গায় আঞ্চলিক আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার স্থাপনের পর ২০১৪ সালে ৪৩ দশমিক ২ ডিগ্রি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। এছাড়া গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ২০২৩ বছরের ১৯ ও ২০ এপ্রিল ৪২ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এছাড়া পর্যায়ক্রমে ২০১৫ সালের ২২ মে ৩৯ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ২০১৬ সালের ১১ ও ২২ এপ্রিল ৪০ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ২০১৭ সালের ৩ এপ্রিল ৩৮ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ২০১৮ সালের ১৮ জুন ৩৯ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ২০১৯ সালের ২৮ এপ্রিল ৩৯ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ২০২০ সালের ৭ এপ্রিল ৩৯ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ২০২১ সালের ২৫ এপ্রিল ৪০ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ২০২২ সালের ২৪ ও ২৫ এপ্রিল মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। চলতি মৌসুমে টানা ১৮ দিন ধরে চুয়াডাঙ্গার ওপর দিয়ে তাপপ্রবাহ বয়ে চলছে।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button