খুলনার বাজারে হঠাৎ বোতলজাত সয়াবিন তেলের সঙ্কট!

# বোতলজাত তেলের পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকলেও কোম্পানীগুলোর তেল দিচ্ছেনা বলে অভিযোগ ব্যবসায়ীদের #
# খোলা সয়াবিন তেলের তুলনায় বোতলজাত তেলের দাম কম হওয়ায় ঢেলে খোলা তেল হিসেবে বিক্রি করছেন বিক্রেতারা #
# বোতলজাত তেল নিতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন ভোক্তারা, সিন্ডিকেট বন্ধে নিয়মিত বাজার মনিটরিংসহ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহনের দাবি ভোক্তাদের #
মো. আশিকুর রহমান ঃ সয়াবিন তেল রান্না-বান্নার ক্ষেত্রে একটি অপরিহার্য পণ্য। প্রতিটি পরিবারে প্রতিদিনই ব্যবহার হয় সয়াবিন তেল। যে কারণে সারাদেশের ন্যায় খুলনার বাজারেও সয়াবিন তেলের ক্রেতা চাহিদা সারা বছর লেগেই থাকে। ক্রেতাদের সয়াবিনের তেলের চাহিদা মেটাতে বসুন্ধরা, তীর, পুষ্টি, রুপচাঁদা, ফ্রেশসহ বেশ কিছু কোম্পানী বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সরবরাহ করে থাকে। পাশাপাশি খোলা সয়াবিন তেলও খুলনার বাজারে নিয়মিত সরবরাহ হয়ে থাকে। তবে অবাক ব্যাপার হঠাৎ করে খুলনার বাজারগুলোতে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। নিত্যপণ্যের দোকানগুলোতে বোতলজাত তেল নেই বললেই চলে। কি কারণে হঠাৎ খুলনার বাজারে বোতলজাত তেলের উপস্থিতি কমে গেছে, তার কারণ হিসাবে ব্যবসায়ীরা বলছেন খোলা বাজারে সয়াবিন তেলের দাম বেশি, কিন্তু বোতলজাত তেলের সেই আগের নির্ধারিত মূল্যই রয়েছে। বর্তমানে খোলা বাজারে পাইকারী ঘরে সয়াবিন তেল পাইকারি বিক্রি হচ্ছে প্রতি মণ (৩৭ কেজিতে মণ ) ৬৬০০ টাকা দরে, যার প্রতি কেজি পড়ছে ১৭৮ টাকা ৩৭ পয়সা বলে নিশ্চিত করেছেন খুলনা নিউ মার্কেটের ব্যবসায়ী আঃ মান্নান। তবে খরচ-খরচা ধরে অনেক ব্যবসায়ী প্রতিকেজি তেল ১৮৪ টাকা করে বিক্রি করছেন। বিপরীতে বোতলজাত তেল ৫০০ গ্রাম ৮৭ টাকা, ১ লিটার ১৬৭ টাকা, ২ লিটার ৩৩৪ টাকা, ৫ লিটার ৮১৮ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। খোলা তেলের তুলনায় বোতলজাত তেলের দাম কম থাকার কারণে অনেক অসাধু ব্যবসায়ী অধিক মুনাফা লাভের আশায় তাদের কাছে মজুতকৃত বোতলজাত সয়াবিন তেলে ঢেলে (খোলা) ভাবে বিক্রি করছেন, অনেক ব্যবসায়ী বোতলের নির্ধারিত মূল্য ছাড়া বাড়তি দাম নিচ্ছেন ক্রেতাদের নিকট হতে। অনেকে আবার বোতলের নির্ধারিত মূল্য মুছে ফেলে ইচ্ছা-স্বাধীন দাম নিচ্ছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। বোতলজাত তেলের পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকলেও খোলা সয়াবিন তেলের তুলনায় বোতলজাত তেলের দাম কম থাকার কারণে কোম্পানীগুলো ব্যবসায়ীদের চাহিদার তুলনায় বাজারে তেলে সরবরাহ করছে না। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ২/৩ সপ্তাহ ধরে কোম্পানীর বিক্রয় প্রতিনিধিদের কাছে তেল চেয়ে তেল পাওয়া যাচ্ছে না। বিক্রয় প্রতিনিধিরা বলছে, কোম্পানীতে তেলের সরবরাহ কম। যদি কোনো ব্যবসায়ীকে দু’চার কার্টুন তেল দেওয়া হচ্ছে, তাও আবার শর্ত সাপেক্ষে। সয়াবিন তেল নিতে গেলে তার বিপরীতে আটা, সরিষার তেল, চিনি বা অন্য কোনো আইটেমের পণ্য (স্লো আইটেম) বাধ্যতামূলক কিনতে হবে, তবেই মিলছে দু’চার কার্টুন সয়াবিন তেল। পাশাপাশি বর্তমানে ব্যবসায়ীরা পূর্বে যে দামে বোতলজাত কোম্পানীর তেল কিনেছেন তা হতে আরো ২/৩ টাকা বেশি দাম রাখছে কোম্পানী। খোলা বাজারে প্রতি কেজি সয়াবিন তেল পাইকারী বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি ১৮৪ টাকা, যা ব্যবসায়ীরা কিনছে ১৮২ টাকা দরে বলে জানিয়েছেন দৌলতপুর বাজারের পাইকারী তেল ব্যবসায়ী জয়নাল। তবে বাজারের কিছু ব্যবসায়ীসহ স্থানীয় পাড়া-মহল্লার মুদি দোকানের ব্যবসায়ীরা খোলা তেল ১৯৫/২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছে। রবিবার (২৪ নভেম্বর) নগরীর সন্ধ্যা বাজার, নিউ মার্কেট বাজার, দৌলতপুর, খালিশপুর চিত্রালী বাজার, মিয়া পাড়া বাজারসহ নগরীর স্থানীয় পাড়া-মহল্লার দোকান ঘুরে এসব তথ্য জানা গেছে। খুলনার বাজারে বোতলজাত তেলের উপস্থিতি কমে যাওয়া, অসাধু ব্যবসায়ী অধিক মুনাফা লাভের আশায় বোতলজাত তেল খুলে খোলা তেল হিসাবে বিক্রি করা, বোতলজাত কোম্পানীগুলো ব্যবসায়ীদের তেল সরবরাহের জন্য শর্ত বেঁধে দেওয়াসহ সার্বিক বিষয় নিয়ে ইতোমধ্যে কার্যক্রম শুরু করেছে খুলনা ভোক্তা অধিকার ও সংরক্ষণ অধিদপ্তর বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। মেহেদী হাসান নামের একজন ক্রেতা জানান, বোতলজাত তেল না পেয়ে ২০০ টাকা কেজিতে খোলা তেল কিনতে হয়েছে। বাজারে বোতলজাত তেলের উপস্থিতি কম থাকায় সুযোগে কিছু অসাধু ব্যবসায়ীরা তেল ১৯৫/২০০ দরে বিক্রি করছে।
চিত্রালী বাজারে আসা অপর ক্রেতা ফাহমিদা জানান, নিত্যপণ্যের বাজারের কি অবস্থা। দীর্ঘদিন বাজারে অস্বস্তি লেগেই আছে। কাঁচা সবজি, আলু, পেঁয়াজ এখন আবার তেল নিয়ে অস্বস্তি। আশ্চার্য বিষয় বাজার হতে বোতলের তেল যেন উধাও। ৫ লিটার তেল চাইলে দোকানদার দিতে পারছেনা। উত্তরে বলছে, কোম্পানী তেল দেয় না। লাভবান হচ্ছে ব্যবসায়ীরা, আর আমরা ক্রেতারা ঠকবো। নিয়মিত বাজার মনিটরিংয়ের দাবি জানাচ্ছি। দৌলতপুর বাজার নুরুল হক স্টোরের মালিক নুরুল হক জানান, প্রায় ৩ সপ্তাহ হলো কোনো কোম্পানী বোতলজাত সয়াবিন তেল দিচ্ছে না। পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকলেও কোম্পানী তেল দিচ্ছে না। কারণ খোলা বাজারে সয়াবিন তেলের দাম বেশি, বিপরীতে বোতলজাত তেলের দাম কম। কোম্পানীর প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন খোলা তেলের ভ্যাট নাই, বিপরীতে বোতলজাত তেলের জন্য ১৫% ভ্যাট দেওয়া লাগে। নতুন দাম নির্ধারন হওয়া পর্যন্ত পর্যাপ্ত তেল পাওয়া যাবে না। মের্সাস নাজমুল এন্টার প্রাইজের মালিক ব্যবসায়ী নাজমুল জানান, তেল কোম্পানীর প্রতিনিধিরা প্রায় ২ সপ্তাহ হলো খোঁজ খবর নেয় না। আমার প্রতি সপ্তাহে ৫০০ গ্রামের ১ কার্টুন, ১ লিটার ২ কার্টুন, ২ লিটার ২ কার্টুন ও ৫ লিটার ৩ কার্টুন তেলের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু এই চাহিদা থাকলেও কোম্পানী তেল দিচ্ছে না। যদিও ১/২ কার্টুন তেল পাওয়া যাচ্ছে, তবে শর্ত সাপেক্ষ। তেল নিতে হলে সাথে সরিষার তেল, মসলা, চা-পাতি বা আটা নিতে হচ্ছে, নইলে কোম্পানী তেল দিচ্ছে না। এদিকে দোকানে পর্যাপ্ত তেলের চাহিদা না থাকার কারণে ক্রেতাদের চাহিদা মেটাতে পারছিনা, অনেক ক্রেতাই ফিরে যাচ্ছেন। মের্সাস মোল্লা স্টোরের ব্যবসায়ী নাজমুল জানান, বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের দামের তুলনায় খোলা তেলের দাম বেশি। যে কারণে অনেক ব্যবসায়ী বোতলজাত তেলে ঢেলে খোলাভাবে বিক্রি করছে। এতে অধিক মুনাফা প্রত্যাশি ব্যবসায়ীরা দাম বেশি পাচ্ছে। যে কারণে বাজারে বোতলজাত তেলের দেখা কম মিলছে। অপরদিকে, খোলা বাজারে সয়াবিন তেলের দাম বেশি ও বোতলজাত তেলের দাম কম হওয়াই কোম্পানীর পর্যাপ্ত তেলের সরবরাহ থাকলেও তেল দিচ্ছে না। যদিও ১/২ কার্টুন তেল দিচ্ছে তাও শর্ত সাপেক্ষে। তেল নিতে হলে চিনি, আটা, লবণ বা অন্য কোনো প্রোডাক্ট নিতে হবে। মোট কথা ৫ হাজার টাকার বোতলজাত সয়াবিন তেল পেতে হলে ১০ হাজার টাকার অন্য কোনো পণ্য নিতে হবে। আমার পক্ষে অন্য কোনো পণ্য নেওয়া সম্ভব নয়, তাই তেল নিচ্ছি না। আমরা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা আছি মহা বিপদে।
খুলনার নিউ মার্কেটের মানিক-রতন স্টোরের মালিক মানিক জানান, মার্কেটে প্রতিটি বোতলজাত তেল কোম্পানীর চাহিদার তুলনায় তেলের ঘাটতি রয়েছে। বর্তমানে কোম্পানীর প্রতিনিধিরা আসে, মালের অর্ডার নিয়ে চলে যায়, কিন্তু মালের দেখা মেলে না। ৫ কার্টুন মালের অর্ডার দিলে ২ কার্টুন মাল দিচ্ছে। তাও আবার শর্ত সাপেক্ষে। তেল নিতে হলে ওই কোম্পানীর মসলা, চা বা অন্য কোনো স্লো আইটেম নিতে হবে। ব্যবসা করবো কি করে। তীর কোম্পানীর বিক্রয় প্রতিনিধি জানান, বর্তমানে বাজারে খোলা তেলের দাম বেশি, বিপরীতে বোতলজাত তেলে দাম কম। তাছাড়া আমাদের তেলের চাহিদা ৫০০ কার্টুন থাকলেও কোম্পানী দিচ্ছে ৩০০ কার্টুন। কম বেশি করে মার্কেটে দিচ্ছি। তবে অধিক মুনাফা লাভের আশায় কিছু ব্যবসায়ী বোতলজাত তেল খুলে খোলা তেল হিসাবে বিক্রি করছে। প্রতি সপ্তাহে মার্কেটে তেল দিচ্ছি। রুপচাদা বোতলজাত তেল কোম্পানীর বিক্রয় প্রতিনিধি জানান, বর্তমানে মার্কেটে বোতলজাত তেলের চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম। কোম্পানী মার্কেটে তেল কম দিচ্ছে। মার্কেটে তেলের সরবরাহ কেন কম এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারি না। রূপচাঁদা সয়াবিন তেলের পরিবেশক মোঃ শফিকুল ইসলাম তুহিন জানান, আমাদের চাহিদার তুলনায় কোম্পানীর বোতলজাত সয়াবিন তেলের সরবরাহ ৫০ শতাংশে নেমে এসেছে। তাছাড়া আমরা খুচরা ব্যবসায়ীদের যা দিচ্ছি সেটা তারা আবার অধিক লাভের জন্য বোতলজাত তেল ঢেলে খোলা তেল হিসেবে বিক্রি করছে ফলে বাজারে বোতলজাত তেলের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। তীর সয়াবিন (বোতলজাত) তেলের খুলনার এরিয়া ম্যানেজার তপন কুমার জানান, বর্তমানে আমাদের মার্কেটে চাহিদার তুলনায় বোতলজাত তেলের সরবরাহ কম। কি কারণে মার্কেটে বোতলজাত তেলের সরবরাহ কম এ ব্যাপারে ম্যানেজমেন্ট ভালো বলতে পারবে।
পুষ্টি সয়াবিন (বোতলজাত) তেলের খুলনার রিজিওনাল ম্যানেজার আবুল ফয়েজকে খুলনার বাজারে চাহিদা তুলনায় কেন বোতলজাত তেলের সরবরাহ কম এ বিষয়ে জানতে চাইলে উত্তরে তিনি জানান, মার্কেটে তেলের কোনো সরবরাহের ঘাটতি নাই। প্রতিটি দোকানদারকে চাহিদা অনুসারে তেল দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু খোলা তেলের দাম বেশি থাকার দরুন ব্যবসায়ীরা বোতলের তেল ঢেলে খোলা বিক্রি করছে। যে কারণে ডিসপ্লেতে বোতলজাত তেলের তেমন দেখা মিলছেনা। কিন্তু মার্কেটে তেলের কোনো ঘাটতি নাই।
ভোক্তা অধিকার ও সংরক্ষন অধিদপ্তর খুলনা জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. ওয়ালিদ বিন হাবিব জানান, খুলনার বাজারে বোতলজাত তেলের উপস্থিতি কমে গেছে, একই সাথে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অধিক মুনাফা লাভের আশায় বোতলজাত তেল খুলে খোলা তেল হিসাবে বিক্রি করছে। তাছাড়া ব্যবসায়ীদের তেল সরবরাহের জন্য শর্ত বেধে দিচ্ছে তেল কোম্পানীগুলো, এ বিষয়ে অভিযোগ পেয়েছি। ইতোমধ্যে এই বিষয়টি সামনে রেখে আমরা আমাদের কার্যক্রম শুরু করেছি। ভোক্তার অধিকার লঙ্ঘন কোনো ভাবেই মেনে নেওয়া হবে না। এ ব্যাপারে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহন করবো।