স্থানীয় সংবাদ

নতুন বাংলাদেশে বিজয় দিবস

ড. জি কে এম মোস্তাফিজুর রহমান : চব্বিশের রক্তস্নাত জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে অর্জিত নতুন বাংলাদেশে (বাংলাদেশ ২.০) এবারের বিজয় দিবসের মর্যাদা ও তাৎপর্য অপরিসীম। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার দুনির্বার আন্দোলনে দেড় দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের জনগণের ওপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনের পর এবারের বিজয় দিবসে যোগ হয়েছে সত্যিকারের অবাধ স্বাধীনতা আর অনাবিল মুক্তির স্বাদ! গোটা জাতি আজ বিভেদ-বৈষম্যহীন শান্তির পরিবেশে ঐক্যবদ্ধভাবে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে পালন করবে এবারের বিজয় উৎসব।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় ইতিহাসের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। আজ থেকে ৫৩ বছর আগে, লাখো শহীদের রক্ত আর অগণিত মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত ৫৬ হাজার বর্গমাইলের আমাদের প্রিয় এ দেশ, বাংলাদেশ। একাত্তরে, এ ভূখ-ের সাড়ে সাত কোটি মানুষ শামিল হয়েছিল মুক্তির তেজোদীপ্ত লড়াইয়ে। মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা আর সামাজিক ন্যায়বিচারের একটি দেশ হবে বাংলাদেশ। পরিতাপের বিষয় হলেও এটি সত্যি যে, বাস্তবে তার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাইনি। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে থাকা এসব অঙ্গীকার এমনকি সংবিধানেও জায়গা করে নিতে পারেনি। উল্টো বিগত দেড় দশকে মুক্তিযুদ্ধের একমুখী বয়ান, আরো নির্দিষ্ট করে বললে মুক্তিযুদ্ধকে একক ব্যক্তির ব্যক্তিগত অর্জন আকারে ফলাও করে সম্প্রচারের সবরকম অপচেষ্টা চালানো হয়।
বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী পেরুলেও সাম্যের বদলে দেশে ধনবৈষম্য বেড়েছে জ্যামিতিক হারে। লাখ লাখ কপর্দকহীন মানুষের বিপরীতে ভূঁইফোড়ের মতো গজিয়ে উঠেছে বিলিয়নিয়ার আর মিলিয়নিয়ার। ব্যাংক লুট, দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার, সিন্ডিকেট, চাঁদাবাজি, ফেরেববাজি সবমিলিয়ে মানুষের মানবিক মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে প্রতিনিয়ত। রাষ্ট্রের নাগরিকের বদলে জনগণকে নতজানু প্রজা বানিয়ে রাখা হয়েছে। মানবাধিকারকে তুচ্ছ করা হয়েছে দিনের পর দিন। বিচারিক ও বিচারবহির্ভূত হত্যা ছিল সাধারণ ব্যাপার। সবমিলিয়ে সামাজিক ন্যায়বিচারের কোনো পরিসর রাষ্ট্র তৈরি করেনি। শেখ হাসিনার একদলীয় ফ্যাসিবাদী শাসন ভর করেছিল মহান মুক্তিযুদ্ধকে। একে দলীয়, নির্দিষ্ট করে বললে পারিবারিক সাফল্যের ইতিকথা বানিয়ে ফেলেছিল তার সরকার। অস্বীকার করা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক ইতিহাস আর বাস্তবতা। অস্বীকার করা হয়েছিল শেখ মুজিবের বাইরে বাকি সবার অবদান।
আজকে জুলাই বিপ্লবের ফসল নতুন বাংলাদেশের নতুন প্রেক্ষাপটে যখন বিজয় দিবস উদযাপন হবে, তখন আমরা চাই জনযুদ্ধের বাস্তবতা থেকে মুক্তিযুদ্ধকে দেখার দিন শুরু হোক। সে সময়ের সাড়ে সাত কোটি বাঙালির অন্তত সাড়ে ৭০০ কোটি উপাখ্যান রয়েছে, যা মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ে বিন্দু বিন্দু করে ভূমিকা রেখেছে। ব্যক্তি বা দলীয় প্রীতি সরিয়ে সেই গণইতিহাসে এবার নজর দেয়া প্রয়োজন। মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে বছরের পর বছর ক্ষমতায় ছিল শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী সরকার।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে শুরু হওয়া শিক্ষার্থীদের কর্মসূচির মধ্য দিয়ে জুলাই-আগস্টে যে বিপ্লব হয়েছে, তার অঙ্গীকার হলো বাংলাদেশকে সব অর্থে পুরোপুরি বদলে দেয়া। রাষ্ট্র ও সংবিধান সংস্কারের অঙ্গীকার নিয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরাও এখন প্রতিনিধিত্ব করছেন অন্তর্র্বতী সরকারে। নতুন করে সংবিধান লেখার কথা এখনো বলে যাচ্ছেন তারা। সে কারণে জনমনে প্রত্যাশা আছে, এ অন্তর্র্বতী সরকার নতুন সংবিধানে মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার হিসেবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা আর সামাজিক ন্যায়বিচারকে স্থান করে দেবে।
বিজয় নিশান উড়ছে আজ বাংলাদেশের ঘরে ঘরে- আমরা চাই এই নিশান চির উড্ডীন থাকুক। রক্তক্ষয়ী জনযুদ্ধে অর্জিত বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে দাঁড়িয়ে থাকবে গর্বিত এ দেশের জনগোষ্ঠীর স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে। একাত্তরের লাখো শহীদের রক্তের ধারায় আবু সাঈদ-মুগ্ধদের শোণিত ধারা আজ মিশে একাকার। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মত্যাগী লাখো শহীদের স্মৃতির সাথে সাথে চব্বিশের সহস্র শহীদের প্রতি গোটা জাতি গভীর শ্রদ্ধায় আনত হবে এ বিজয় দিবসে। রক্তস্নাত জনযুদ্ধে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল যে চেতনা, তার প্রতিফলন আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ।
তাই দ্বিতীয়বারের মতো স্বাধীনতা অর্জনের এ বিরল মাহেন্দ্রক্ষণে নতুন উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে উদযাপিত হবে এবারের বিজয় দিবস, তাই এর তাৎপর্য অন্যরকম। এ বিজয় আমাদের আলোর দিশারী হয়ে আগামীর পথ দেখাবে। সব বাধা, বিভেদ ও বৈষম্য দূর করে গণমানুষের স্বতঃস্ফূর্ত মতামত ও যথাযথ গণসম্মতির ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সব সংস্কার সাধন করে গড়ে উঠবে আগামীর সুখী ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। লেখক : ভাইস-চ্যান্সেলর, বশেমুরকৃবি।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button