স্থানীয় সংবাদ

খুলনায় অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে জমির মৌজা রেট : কেনা-বেচায় নেতিবাচক প্রভাবের আশংকা

বাড়বে জমি রেজিস্ট্রি খরচ
বানিয়াখামার মৌজায় শতাংশে সাড়ে চৌদ্দ লাখের বেশি
কয়রার মহেশ^রীপুরে দ্বিগুণ
উপজেলা পর্যায়ে বাড়ছে হোল্ডিং ট্যাক্সও

কামাল মোস্তফা : জমি রেজিস্ট্রশনে সারা দেশের মত খুলনায় নতুন মৌজা রেট কার্যকর হয়েছে। আগামী দুই বছরের জন্য সংশোধিত মৌজা রেট অনুমোদন করে গত বৃহস্পতিবার ১ জানুয়ারী নিবন্ধন অধিদপ্তর থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। নতুন মৌজা রেট নির্ধারণের পর জমি ক্রেতা-বিক্রেতাসহ এই খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। দেশের এমন অস্থিতিশীল অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে জমির মৌজা রেট বাড়ানোয় সৃষ্টি হয়েছে সমালোচনা। মৌজা রেট বাড়ায় বাড়বে জমির রেজিস্ট্রি খরচ, কমবে কেনা-বেচা। কেনা-বেচা কমায় রাজস্ব হারাবে সরকার। এদিকে, উপজেলা পর্যায়ে হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়ায় অসস্তিতে পড়বে সাধারণ জমি মালিকরা।
সূত্রমতে, সংশোধিত নতুন মৌজা রেটে সরকারি হিসাবে প্রতি অযুতাংশ জমির শ্রেণিভিত্তিক মূল্য সর্বনিম্ন ১০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। আবার কোথাও বাড়ির চেয়ে ভিটি শ্রেণির দাম বেশি ধরা হয়েছে। খুলনায় কোন কোন মৌজায় দ্বিগুণ, কোন মৌজায় তিনগুণও বাড়ানো হয়েছে। খুবই কমসংখ্যক মৌজায় পূর্বের মূল্য অপরিবর্তিত রয়েছে। এরমধ্যে কিছু মৌজার বেশিরভাগ জমি সরকার আগেই অধিগ্রহণ করেছে।
নিবন্ধক অধিদপ্তরের আদেশে বলা হয়, সম্পত্তির সর্বনিম্ন বাজারমূল্য নির্ধারণ বিধিমালা-২০১০ (সংশোধিত ২০১২ ও ২০১৫) অনুযায়ী ২০২৫ ও ২০২৬ সালের জন্য প্রস্তুতকৃত বাজারমূল্য তালিকা ১ জানুয়ারি থেকে পরবর্তী দুই বছরের জন্য কার্যকর করা হয়েছে। সরকারি হিসাবে মৌজাভিত্তিক জমির সর্বনিম্ন গড় বাজারমূল্য ধরে সংশোধিত মৌজা রেট নির্ধারণ করা হয়েছে। অর্থাৎ এই মূল্যের নিচে জমি রেজিস্ট্রি করা যাবে না।
নতুন নির্ধারণ করা মৌজা মূল্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, খুলনা সদর সাব রেজিস্ট্রারের আওতাধীন মৌজার বাসÍু এবং বানিজ্যিক শ্রেণির মূল্য বাড়ানো হয়েছে অস্বাভাবিক হারে এমনটাই অভিযোগ জমির মালিকদের। সদরের বানিয়াখামার মৌজায় বাস্তু শ্রেণির জমির পূর্ব মূল্য ছিল ৮,৪৮,২৭৩ টাকা। বর্তমানে তা ১৪,৫৯২০৫ টাকা বাড়িয়ে করা হয়েছে ২৩,০৭৪৭৮ টাকা। যা পূর্ব মূল্য থেকে তিনগুণ বেশি। বাণিজ্যিক শ্রেণির জমির পূর্ব মূল্য ছিল ২৯,৬৫,৮৪৬ টাকা, বর্তমানে ২,৩৫,৭১৪ টাকা বাড়িয়ে করা হয়েছে ৩১,০১,৫৬০ টাকা। এ ছাড়া হেলাতলা মৌজায় বাস্তু ছিল ১৭,৮৮৫৩২ টাকা, বাড়িয়ে করা হয়েছে ২০,৪১,০৮৭ টাকা।
খুলনা সদর সাব রেজিস্ট্রার তন্ময় কুমার মন্ডল বলেন, মৌজা মূল্য বৃদ্ধি আমরা নিজেদের ইচ্ছামত করি না। বিগত দুই বছরের জমি কেনা বেচার দলিল বিশ্লেসন করে নির্ধারণ করা হয়।
ডুমুরিয়া উপজেলায় মৌজা রয়েছে মোট ১০৫টি, যার সবকটি মৌজায় বাড়ানো হয়েছে মূল্য। চুকনগর মৌজায় পূর্বে বাড়ি শ্রেণির জমির শতাংশ প্রতি মূল্য ছিল ২,২৬,৪২৭ টাকা, সংশোধিত মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৩,১৬,৭৪৯ টাকা, অর্থাৎ ৯০,৩২২ টাকা বেশি। একই মৌজায় বিলান জমির মূল্য ছিল ২০৬৭২৭ টাকা, সংশোধিত মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ২,৯২,৮৯৪ টাকা যা পূর্বেও মূল্য থেকে ৮৬,১৬৭ টাকা বেশি। এ ছাড়া চকমথুরাবাদ মৌজায় বাড়ি শ্রেণির জমির পূর্ব মূল্য ছিল ৬,৭৫,২৫৬ টাকা, বর্তমান মূল্য ৮,৫৫,৩০২ টাকা, অর্থাৎ ১,৮০,০৪৬ টাকা বেশি। বিলান জমির পূর্ব মূল্য ছিল ২,৫৮,৭৩৫ টাকা, বর্তমান মূল্য ৪,৪৪,৮৩৪ টাকা, যা পূর্ব মূল্য থেকে ১,৮৬,০৯৯ টাকা বেশি।
ডুমুরিয়া উপজেলার চকমথুরাবাদ মৌজার জমি কিনতে আগ্রহী বেসরকারি চাকুরীজিবী কামরুল ইসলাম বলেন, জমির মৌজা রেট যেভাবে বাড়ানো হয়েছে তাতে রেজিস্ট্রি খরচ যা বাড়বে সেই খরচ যোগাতে গিয়ে আর জমি কেনা সম্ভব হবে না। খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি অবস্থাটা ঠিক এমনই হয়েছে।
জেলায় সবচেয়ে বেশি জমি কেনা-বেচা হয় বটিয়াঘাটা উপজেলার আওতাধীন মৌজাগুলোতে। এখানে মৌজা রয়েছে ১৩২ টি, সেখানেও সবকটিতে বেড়েছে জমির মৌজা মূল্য। উপজেলার কৃষ্ণনগর মৌজায় বাস্তু শ্রেণির জমির পূর্ব মূল্য ৫,৭৩,৭৩৩ টাকা, বর্তমানে ১,৪২,৫২১ টাকা বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে ৭, ১৬,২৫৪ টাকা। বিলান শ্রেণির জমির পূর্ব মূল্য ৩,৭২,৭৭১ টাকা, বর্তমানে ১,২৫,৪৫৯ টাকা বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে ৪,৯৮,২৩০ টাকা। দেনারাবাদ মৌজায় বাস্তু শ্রেণির জমির মূল্য ছিল ৬, ১৩,৮৬৫ টাকা, শতাংশ প্রতি ৩,২৫,৩২০ টাকা বাড়িয়ে করা হয়েছে ৯,৩৯,১৮৫টাকা। একই মৌজায় বিলান জমির পূর্ব মূল্য ছিল ৫,৯৬৬১৫ টাকা, সেখানে ২,৮০,৬৫৯ টাকা বাড়িয়ে করা হয়েছে ৮,৭৭,২৭৪ টাকা।
কয়রা উপজেলার ৭১ টি মৌজার ২০২৩-২০২৪ সালের মূল্য ২০২৫-২০২৬ সালের জন্য সকল শ্রেণির জমিতেই বাড়ানো হয়েছে। কয়রা সদরের মদিনাবাদ মৌজায় বাস্তু শ্রেণির মূল্য ছিল ২,২৮,৬৪৫ টাকা। সেখানে ২১,৯৭৬ টাকা বাড়িয়ে করা হয়েছে ২,৫০,৬২১ টাকা। বিলান শ্রেণির জমির পূর্ব মূল্য ২৬,০০১ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩৮,৬৭৭ টাকা করা হয়েছে। প্রত্যন্ত এলাকা মহেশ^রীপুর মৌজায় বাস্তু শ্রেণির জমির পূর্ব মূল্য দুই বছরের ব্যবধানে দ্বিগুন করা হয়েছে। ১০,৪২৭ টাকা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ২২,৪৩৫ টাকা।
কয়রা সাব রেজিস্ট্রি অফিসের দলিল লেখক বাপ্পী রায় বলেন, নতুন মৌজা রেটে জমি কেনা-বেচা কমে যাবে। রেজিস্ট্রি খরচ বেড়ে যাওয়ায় সরকার রাজস্ব হারানোর পাশাপাশি আমরা যারা এই পেশায় যুক্ত আমাদেও চলা কঠিন হবে।
গ্রামাঞ্চলে বা ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে বসবাসরত সাধারণ জনগণের জন্য ফুটের হিসাবে ট্যাক্স হিসাব করা হয় না। সে ক্ষেত্রে স্থানভেদে সর্বোচ্চ ৭ থেকে ১ শতাংশ পর্যন্ত কর আরোপিত হয়। অর্থাৎ বেশি মূল্যের জমির স্থানে সর্বোচ্চ ৭ শতাংশ এবং কম মূল্যের জমির স্থানে সর্বনি¤œ ১ শতাংশ কর আরোপ করা হয়। মৌজা রেট বেড়ে যাওয়ায় জমির মালিকের কর বেড়ে যাবে।
কয়রা উপজেলার মহেশ^রীপুর ইউনিয়নের মহেশ^রীপুর মৌজার বাসিন্দা স্কুল শিক্ষক আবুল কালাম বলেন, উপজেলা সদর থেকে মহেশ^রীপুরের দূরত্ব প্রায় ১০-১২ কিলোমিটার। এমন প্রত্যন্ত এলাকায় জমির মৌজা রেট দ্বিগুন করা সঠিক হয়নি। এতে করে আমাদের ট্যাক্স বেড়ে যাবে।
খুলনা সদর দলিল লেখক সমিতির সভাপতি বাহাউদ্দিন খন্দকার বলেন, দেশের ভঙ্গুর অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে এই মুহুত্বে জমির মৌজামূল্য বৃদ্ধি আমাদের বিপাকে ফেলেছে। নতুন রেট নির্ধারণ করার পর থেকে জমি রেজিস্টেশন নেই বলইে চলে। এভাবে চলতে থাকলে এই পেশায় টিকে থাকাই কঠিন হবে।
বাজার মূল্য নির্ধারণ কমিটির সভাপতি জেলা রেজিস্টার মোঃ আব্দুল হাফিজ বলেন, বিগত ২ বছরের বাজারমূল্যকে গড় করে শতাংশে ভাগ করে মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। ধরেন কেউ ৫ শতাংশ জমি কিনেছে ১ কোটি টাকায়। প্রতি শতাংশের মূল্য আসে ২০ লাখ টাকা। এভাবে দুই বছরের বেচা কেনার দলিল যাচাই বাছাই করে গড় করে মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এখানে আমাদের মনগড়া কোন মূল্য চাপিয়ে দেয়া হয়নি। তিনি আরও জানান, প্রস্তুতকৃত বাজারমূল্য সম্পর্কে কোন আপত্তি থাকলে জেলা বাজারমূল্য নির্ধারণ কমিটির সদস্যসচিব বরাবর পুনর্বিবেচনার আবেদন করতে পারবেন।
মোহাম্মাদীয়া আবাসন প্রকল্পের স্বত্ত্বাধিকারী রাসেল হাসান বাবু ব্যবসায়ী বলেন, হঠাৎ করে জমির মৌজা মূল্য বৃদ্ধি করায় আবাসন ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্থ হবে। রেজিস্ট্রি খরচ বেড়ে যাবে ফলে জমি কেনাবেচা কমে যাবে। ফলে সরকার আগে যে পরিমাণ রাজস্ব পেতো এখন তা কমে যাবে।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button