স্থানীয় সংবাদ

কেসিসি মার্কেট ঘিরে বিশাল জালিয়াত সিন্ডিকেট

৩০ মিনিটেই পাওয়া যায় ৭০ বছরের পুরানো জমির ভূয়া দলিল
অত্যাধুনিক প্রিন্টারে তৈরী হয় কাবিননামা, সার্টিফিকেট ও ব্যাংক চেক
৫শ’ থেকে হাজার টাকায় মেলে জাল এনআইডি-সরকারি আইডি কার্ড
প্রশাসনের নাকের ডগায় জালিয়াতির এই পসরা বসলেও পদক্ষেপ নেই

মোঃ মুশফিকুর রহমান মেহেদী : খুলনা জেলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা বটিয়াঘাটা ও ডুমুরিয়া। দেশ বিভক্তির সময় এ অঞ্চলে বসবাসরত বেশ কিছু হিন্দু পরিবার পাড়ি জমায় ভারতে। পূর্বে যাদের স্থায়ী ঘরবাড়ি ছিল ডুমুরিয়া ও বটিয়াঘাটায়। তাদের রেখে যাওয়া হাজার হাজার বিঘা ভূ-সম্পত্তির অধিকাংশই এখন অন্যদের দখলে। কেউ খাস সম্পত্তি হিসেবে লীজ নিলেও কেউবা জাল জালিয়াতির মাধ্যমে হয়েছেন জমির মালিক। একটি দালাল চক্র এ সকল জমির সন্ধানে থাকেন। সন্ধান মিললেই জমিদাতার তথ্য খুঁজে বের করেন। সে সঙ্গে শুরু হয় জাল কাগজপত্র তৈরির কর্মযজ্ঞ। তবে, প্রশাসনের নাকের ডগায় জাল-জালিয়াতির এই পসরা বসলেও নেয়া হয়না কোন পদক্ষেপ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সহজেই মিলছে ৫০ থেকে ৭০ বছর পূর্বের জমির মালিকের স্বাক্ষরকৃত দলিল। এই চক্রের একজন সদস্যের পূর্ব পুরুষের নাম, গ্রহীতা হিসেবে দেখিয়ে মূহুর্তেই তৈরী হয় দলিল। মাত্র ত্রিশ মিনিটের মধ্যে তৈরী করে দেওয়া হয় এই ভূয়া দলিল। এছাড়া ভূয়া কাগজ বানিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে অসংখ্য মানুষকে। জাল-জালিয়াতির এই সিন্ডিকেট খুলনা জেলা পরিষদ সংলগ্ন কেসিসি মার্কেট ও এর আশ-পাশ এলাকা ঘিরে গড়ে উঠেছে। বেশ কয়েকজন দলিল লেখক, কম্পিউটার অপারেটর, আদালতের মুহুরী, অনলাইন ভূমি সেবা প্রদানকারী ব্যক্তি এই সিন্ডিকেটে সম্পৃক্ত।
শুধু তাই নয়। অনুসন্ধানে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে। একটি চক্র সরকারি চাকরি, জমি কেনা বেচা ও ব্যবসায়ে বিনিয়োগসহ নানা প্রলোভন দেখিয়ে হাতিয়ে নেয় কয়েক লক্ষ টাকা। টাকা গ্রহণ করার সময় গৃহীত টাকার অঙ্ক উল্লেখ করে একটি ব্যাংক চেক প্রদান করে। পরবর্তীতে ঐ চক্রটি টাকা প্রদানে অস্বীকৃতি জানালে ব্যাংকে গিয়ে দেখা যায় চেকটি জাল। অত্যাধুনিক স্ক্যানিং প্রিন্টারের মাধ্যমে হুবহু চেক বানিয়ে ফেলে চক্রটি।
বটিয়াঘাটার গোপাল দাশ নামক একজন ব্যক্তি বলেন, “আমাদের জমি ৩ প্রজন্ম ধরে ভোগ দখল করে আসছি। হঠাৎ শুনি আমার ঠাকুর দা কাকে লিখে দিছে। পরে জানতে পারি সব কাগজ জাল। এদিকে একই উপজেলার মাথাভাঙায় একটি চক্র এই প্রক্রিয়ায় জালিয়াতি করে বেশ কয়েকটি জমি জোর করে দখল নিয়েছে। এ চক্রটি ওয়ারেশকায়েম সার্টিফিকেট, দলিল, নোটারী স্ট্যাম্প, এফিডেভিট কপিসহ বেশ কিছু জাল কাগজ তৈরী করে কেসিসি মার্কেট থেকে। তবে খুলনার জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সংলগ্ন ও আদালত পাড়ার কয়েকটি দোকানও এই কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত রয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে।
দীপ্ত বাছাড় নামক একজন যুবক বলেন, ‘আমার পরদাদার রেখে যাওয়া সম্পত্তি দ্বারিখ বাছাড় নামে জাল দলিল করে একজন ব্যক্তি জোরপূর্বক দখল করার চেষ্টা চালাচ্ছে। কোর্ট এলাকার আশেপাশের কোনো দালালের মাধ্যমে জাল দলিল বানিয়েছে। এখন তাদের ঐ জাল কাগজ প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে আমাদের আসল ওয়ারিশ কাম সার্টিফিকেট জাল পরিচয়ে, বিভিন্ন মামলা দিয়ে হয়রানি করছে। আমরা গরীব ও অসহায় বলে সুবিচার পাচ্ছি না।
মুরসালীন হক (ছদ্মনাম) নামক এক ব্যক্তির সাথে অনলাইনে পরিচয় হয় এক নারীর। পরিচিতির এক পর্যায়ে ওই নারীর সাথে প্রেমের সম্পর্ক তৈরী হয়। তবে, কিছুদিন যেতে না যেতেই ঐ নারী শুরু করে ব্লাকমেইলিং। নগদ টাকা না দিলে ম্যাসেজে কথোপকথনের স্ক্রিনশট পরিবারের কাছে সরবরাহ করবে বলে জানায়। পরে একটি প্রতারক চক্রের মাধ্যমে খুলনা জেলা পরিষদ সংলগ্ন কেসিসি মার্কেট এর একটি কম্পিউটারের দোকান থেকে ভূয়া কাবিননামা তৈরী করে। সেই কাবিনের কপি দিয়ে ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও জাল জালিয়াতির দুটি পৃথক মামলা দেওয়া হয়। তবে পুলিশ তদন্ত করে, ওই ছেলের বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ পায়নি বলে জানা গেছে।
এদিকে, বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য উচ্চতর শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া থাকে। এসকল প্রতিষ্ঠান কিংবা কোম্পানী অনলাইনে যাচাই না করেই নিয়োগ দেয়। এ সুযোগে স্বল্পশিক্ষিত লোকজন চাকরির জন্য বেছে নেই জাল-জালিয়াতির পথ। মাত্র ৫শ’ থেকে ১ হাজার টাকা খরচ করলেই মিলে যায় শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ, স্কুল-কলেজের প্রত্যয়নপত্র, প্রশংসাপত্রসহ একাডেমিক নানা গুরুত্বপূর্ণ কাগজ।
অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, কেসিসি মার্কেটের ধলয় মন্ডল (প্রতিকী নাম) খুব বিচক্ষণতার মাধ্যমে কাজটি করে থাকেন। একটি জাল চেকের জন্য তাকে প্রদান করতে হয় ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা। এছাড়া কেসিসির এই চক্রের মাধ্যমে ব্যাংক চেকসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র প্রিন্ট করে আনা হয় ঢাকার নীলক্ষেত থেকে।
এই বিষয়ে শাহারিয়ার নামক এক ব্যক্তি বলেন, ‘ব্যবসায়ে বিনিয়োগের কথা বলে এক ব্যক্তিকে ১০ লাখ টাকা দিয়েছি। বিনিময়ে আমাকে দিয়েছে জাল চেক। যেটা দিয়ে আমি কিছুই করতে পারছি না।’
সম্প্রতি খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একজন ভূয়া কার্ডধারী চিকিৎসককে আটক করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এ সময় তার কাছে খুলনা মেডিকেলসহ বেশ কয়েকটি হাসপাতালের আইডি কার্ড জব্দ করা হয়। এছাড়া তার নিকট একটি ভূয়া জাতীয় পরিচয় পত্র পাওয়া যায়। এই বিষয়ে মেহেদী হাসান নামক এই ভুয়া চিকিৎসককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে জালিয়াতির ব্যাপারে স্বীকার করেন। তিনি আরো বলেন, এসকল কার্ড কেসিসি মার্কেট থেকে বানানো হয়েছে। তার নিকটতম এক বন্ধুর সাহায্য নিয়ে খুলনা জেলা পরিষদের বিপরীত পাশের একটি কম্পিউটারের দোকান থেকে কার্ডগুলো বানানো হয়েছে বলে সে নিশ্চিত করে। পরবর্তীতে সোনাডাঙ্গা থানা সূত্রে জানা যায়, এই যুবকের বিরুদ্ধে ইতিপূর্বে বেশ কয়েকবার এমন জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়া গেছে।
তবে পূর্বে এসকল কার্যক্রম অহরহ হতো বলে স্বীকার করলেও বর্তমানে কেসিসি মার্কেটের সম্মুখসারির ব্যবসায়ীরা কোন জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত নয় বলে দাবী করেছেন মার্কেটের যুগ্ম আহবায়ক মনজুর শাহিন রুবেল। তিনি বলেন, ভেতরের কিছু ব্যবসায়ীরা এই কাজ করতে পারেন। তবে প্রমাণ পেলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ বিষয়ে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের উপ-কমিশনার মোঃ তাজুল ইসলাম বলেন, জালিয়াতি মারাত্মক অপরাধ। এ বিষয়ে যাচাই বাছাই করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কেএমপি’র উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) শেখ মনিরুজ্জামান মিঠু বলেন, সমাজের অপরাধমূলক কার্যক্রম গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হয়। সরকারি কাগজপত্র জাল জালিয়াতির তথ্য প্রমাণ পেলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী মোঃ মাসুম বিল্লাহ বলেন, সরকারি কাগজ, চাকরির পরিচয়পত্র, এনআইডি নকলকারীদের বিরুদ্ধে কঠিন শাস্তির বিধান রয়েছে। রাষ্ট্রীয় কোনো নথি কিংবা দলিল জাল করলে ৭/১০ বছর কিংবা তার বেশি জেল হতে পারে।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button