‘মোবাইল’ এখন তারুনদের খেলার মাঠ!
# বর্তমানে মাঠ থাকলেও দেখা নেই খেলোয়াড়ের : কারণ এটি মোবাইল আসক্তির কুফল
# এমন একটি আইন করা উচি যেন একটি নির্দিষ্ট বয়সের নীচে কেউ স্মার্ট ফোন ব্যবহার করতে পারবেনা- এড. কুদরত-ই খুদা
মো. আশিকুর রহমান ঃ খুলনা মহানগরীর দৌলতপুর উপশহর এলাকায় স্বনামধন্য কিছু খেলার মাঠ রয়েছে। যার মধ্যে মহেশ^রপাশা, দৌলতপুর কৃষি প্রশিক্ষন ইনষ্টিটিউট, কেডিএ (কল্পতরু), বিএল কলেজ, দেয়ানা উত্তরপাড়া, দেয়ানা দক্ষিনপাড়া, পাবলা সবুজ সংঘসহ দৌলতপুর মুহসীন স্কুল মাঠ উল্লেখযোগ্য। এই মাঠগুলোতে সেই নব্বই দশকের সময়ে দিনব্যাপী ফুটবল, ক্রিকেট, হা-ডু-ডুসহ বিভিন্ন খেলাধুলা চলতো। মাঠে এতই খেলোয়ার খেলাধূলা করতো যে একটু বিলম্ব হলে খেলার জায়গা পাওয়া দুস্কর হয়ে পড়তো। যেখানে বয়সের তারতম্য ছিল না, সকল বয়সীরা খেলাধূলা করতো। আজ সেই মাঠগুলো পড়ে আছে, তবে নেই খেলোয়ার। এমনই কথাগুলো বললেন ফুটবল খেলোয়ার মনু। তিনি জানান, দিনগুলো এখনো চোখের সামনে জ¦ল জ¦ল করে ভাসছে। একটু দেরি করে মাঠে গেলে জায়গা পাওয়া যেতনা। এতদাঞ্চলের বিভিন্ন মাঠে আমরা দলগতভাবে ফুটবল খেলেছি, অনুশীলন খেলেছি। বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের দু’একজন খেলোয়ার, যারা এই মাঠগুলোতে অনুশীলন করেছেন। আজ এসব মাঠে আগের মতো কোনো খেলোয়ার দেখা যায় না। বর্তমানে মাঠ আছে, নেই খেলোয়ার। প্রযুক্তি আমাদের জীবন ব্যবস্থাকে সহজলভ্য করে তুললেও শারীরিক ও মানসিক বাধা হয়ে দাড়িয়েছে একটি ডিভাইস ‘স্মাটর্’ ফোন। বর্তমান তরুন প্রজন্ম মোবাইল আসক্তির কারণে আজ মাঠমুখি হচ্ছে না। যে কারণে তারা শারীরিক ও মানসিক বিকাশে বাধাগ্রস্থ হচ্ছেন। চাকুরীজীবি মো. আক্তারুজ্জামান জানান, নব্বই দশক, সেই সময়ে আমি স্কুলে পড়ি। মনে আছে হাফপ্যান্ট পড়ে একটু বৃষ্টি হলেই বন্ধুদের নিয়ে কৃষি কলেজের মাঠে ফুটবল খেলতে যেতাম। মাঠে এতো বেশি লোকের সমাগম হতো জায়গা পাওয়া যেত না। এতাঞ্চলে বিভিন্ন টুর্নামেন্টে ফুটবল-ক্রিকেট খেলেছি। আজ মাঠ আছে, তবে নেই খেলোয়ার। তরুন প্রজন্ম আজ খেলার মাঠ হতে বহুদূরে সরে গেছে। মোবাইল আসক্তির কারণে তারা মাঠমুখি নয়, তাদের শারিরীক ও মানুষিক বিকাশে অবশ্যই মাঠমুখি হওয়ার পাশাপাশি নিয়মিত খেলাধূলা করতে হবে। বর্তমানে প্রযুক্তির উৎকর্ষে হাতের নাগালে এখন স্মার্ট মোবাইল ফোন। পরিবারের বড় সদস্যদের পাশাপাশি বর্তমানে শিশু-কিশোরদের হাতেও স্মার্ট মোবাইল ফোনের দেখা মেলে হরদম। এই মোবাইল ফোনের আসক্তি কেড়ে নিচ্ছে শিশু-কিশোরদের খেলাধুলার সময়টুকু। সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডসহ মানসিক বিকাশজনিত কর্মকান্ডে একটি গ্রাম বা পাড়া-মহল্লার শিশু-কিশোরদের বড় একটা অংশ অনুপস্থিত। স্মার্ট ফোন অপারেটিং বিশেষ করে, ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটস্অ্যাপ, ইমো, টিকটকসহ বিভিন্ন গেইম, বিশেষ করে লুডুর প্রতি আসক্ত হয়ে একদিকে শিশু-কিশোররা নিজেদের ভবিষ্যতকে হুমকিতে ফেলছে অন্যদিকে এর প্রভাব পড়ছে তাদের বর্তমানেও। রাত জেগে মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করায় শারীরিকভাবে অনেকে নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বাড়ীর পাশে খেলার মাঠ থাকলেও মাঠে নেই খেলোয়ার। মোবাইল এখন তরুনদের খেলার মাঠ হয়ে দাড়িয়েছে। নাগরিক নেতারা বলছেন, খুলনা শহরে মাঠ নেই বললেই চলে। যে মাঠগুলো দখল হয়ে আছে, সেগুলোকে দখলমুক্ত করতে হবে। প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি মাঠ তৈরী করতে হবে। একটি আইন করা উচিৎ একটি নির্দিষ্ট বয়সের নীচে কেউ স্মার্ট ফোন ব্যবহার করতে পারবেনা। মোবাইল ফোন আসক্তিরোধে পারিবারিকভাবে অভিভাবকদের অধিক সচেতন হতে হবে। ‘শিশু-কিশোররা একসঙ্গে বসে মোবাইলে খেলছে অথচ একে-অপরের দিকে তাকিয়ে কথা পর্যন্ত বলছে না। আর এভাবেই সমাজিক আচরণ বা বৈশিষ্ট্যগুলো অর্জন করতে পারছে না শিশুরা। পাশাপাশি তাদের মানসিক বিকাশও ঘটছে না। এখনই মোবাইলের অপব্যবহার রোধ করতে হবে এবং প্রয়োজন ছাড়া শিশু-কিশোররা যেন মোবাইল ব্যবহার করতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। শিশু-কিশোরদের মোবাইল ফোনের অপব্যবহার নিয়ে এ কথাগুলো বলছিলেন সাবেক কাউন্সিলর এসএম হুমায়ূন কবির। আমরা মাঠমুখি ছিলাম, এখনকার প্রজন্ম মাঠমুখি নয়। তারা মোবাইলের প্রতি বেশি আসক্ত। অভিভাবক তানিয়া রহমান বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমরা মোবাইল ফোনে বেশি আসক্তি হয়ে পড়ছি। এতে আমরা অনেক সমস্যা ফেস করছি। শিশুরা মোবাইল দেখে দেখে খাবার খাচ্ছে। সে বিষয়েও আমাদের নজরদারী কম। অনেক সময় বাচ্চারা বাইরে খেলতে যাওয়ার কথা বলে মাবাইলের আসক্তিতে পড়ছে। এই প্রেক্ষাপটের পরিবর্তন দরকার। মোবাইল থেকে বাচ্চাদের কীভাবে দূরে রাখা যায় সে বিষয়ে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি অনুরোধ জানান। সাংস্কৃতিক কর্মী সুজাত কবির জানান, আমাদের সময়ে আমরা সারাদিন মাঠমুখি ছিলাম। দিনরাত মাঠে পড়ে পড়ে ফুটবল, ক্রিকেট খেলতাম। এখন খেলার মাঠ চোখের সামনে পড়ে, কিন্তু মাঠে খেলোয়ার দেখিনা। দুঃখ জনক বিষয় মোবাইল ফোনের যুগে বাচ্চারা এখন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। মোবাইল ফোন আসক্তির কারণে তাদের মনোযোগ নষ্ট হচ্ছে, তাদের চোখ নষ্ট হচ্ছে। বাচ্চাকে শান্ত রাখতে মা-বাবারাও শিশু-কিশোরদের হাতে মোবাইল ফোন দিয়ে রাখছেন। এ মোবাইল ফোন আসক্তি রোধে অভিভাবকদের সচেতন হওয়া প্রয়োজন বলে মনে আমি মনে করি। অভিভাবকরা সচেতন না হলে বাচ্চারা ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়বে। এখনই মোবাইল ফোন আসক্তি রোধ করা না গেলে আগামী দিনের প্রজন্মের শিশুদের মাঝে অন্ধত্ব বাড়বে। মাদ্রাসা শিক্ষক জিয়া চৌধুরী জানান, মোবাইল আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অপরিহার্য একটি বস্তু হয়ে উঠেছে। কোভিড-১৯ এর সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার করে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালানো হয়েছে। বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে যারা স্কুলে পড়ছে, তারাও মোবাইল ব্যবহার করছে। আমরা লক্ষ্য করছি যে, তারা কিছু নিষিদ্ধ সাইটেও প্রবেশ করছে, গেমস খেলছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও তারা অধিকাংশ সময় ব্যয় করছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী ২০ বছর পরে এ প্রজন্মের ভবিষ্যৎত অন্ধকার। সুতরাং, এখনই মোবাইল ফোনের অপব্যবহার যেন না হয় আমাদেরকে সেজন্য সমন্বিতভাবে চেষ্টা করতে হবে। অভিভাবক ফারুক হোসেন সুমন জানান, শারীরিক নানা কষ্ট করে ক্রিকেট খেলায় ১ রান, ২ রান বা ৪/৬ রান করতে হয়। ফুটবল খেলতে হবে দৌড়-ঝাপ করে গোল দিতে হচ্ছে, কিন্তু মোবাইল ফোনে শিশুরা ছয় বলে ছয় ছক্কা মারতে পারছে। ফলে তারা মাঠের প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলছে। এ অবস্থায় দিনকে দিন শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। শুধু শিশুই নয়, আমরা বড়রাও মোবাইলে আসক্তি হয়ে কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলছি। সামাজিকভাবে সবাইকে সচেতন হতে হবে। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)’র খুলনা সাঃ সম্পাদক এড. কুদরত-ই খুদা জানান, খুলনা শহরে মাঠ নেই বললেই চলে। যে মাঠগুলো দখল হয়ে আছে, সেগুলোকে দখলমুক্ত করতে হবে। প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি মাঠ তৈরী করতে হবে। আমাদের আগে মাঠ তৈরী করতে হবে, তারপর বাচ্চাদের মাঠে পাঠাতে হবে। আমরা ২৪ ঘন্টা মোবাইল চালু রাখি। চায়নাতে একটি নির্দিষ্ট সময় আছে ফেসবুক অপারেটিংয়ের জন্য। আমাদেরও একটি নির্দিষ্ট সময় নির্ধারন করা উচিত ফেসবুক অপারেটিং করার জন্য। এছাড়া একটি আইন করা উচিৎ একটি নির্দিষ্ট বয়সের নীচে কেউ স্মার্ট ফোন ব্যবহার করতে পারবেনা। মোবাইল ফোন আসক্তিরোধে পারিবারিকভাবে অভিভাবকদের অধিক সচেতন হতে হবে।